বগুড়া সদর উপজেলা

বিসিকে তৈরি হচ্ছে হাজারকোটি টাকার কৃষিযন্ত্রাংশ

বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরীতে জায়গা সংকটের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে কৃষি যন্ত্রাংশ। সহস্র শ্রমিকের মেধা আর শ্রমে জাহাজ ভাঙা লোহা থেকে তৈরি হচ্ছে কৃষির অতি জরুরি যন্ত্রাংশ।

কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি করে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন এ শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা। বগুড়ায় তৈরি এসব যন্ত্রাংশ বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পে কাজ করছে ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। বছরে লেনদেন প্রায় হাজার কোটি টাকা।

বগুড়া বিসিক শিল্পনগরী ঘুরে জানা যায়, এখানে উৎপাদিত বহু পণ্য ব্যবহার হচ্ছে কৃষিকাজে, ছোট-বড় শিল্প-কারখানা ও বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কলকারখানায়। এখানে তৈরি হচ্ছে শ্যালো ইঞ্জিনের সেচ পাম্প, লায়নার, পিস্টন, টিউবওয়েল, পাওয়ার টিলারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিন, গাড়ির ব্রেক ড্রাম, করাত কল, ফ্লাওয়ার মিল, টেক্সটাইল মিল, অয়েল মিল; এমনকি ধান কাটার মেশিনসহ অন্যান্য মেশিনের যন্ত্রাংশ।

এসব যন্ত্রাংশের ওপর দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। জেলা ছাড়াও পাবনা, নাটোর, টাঙ্গাইল, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বগুড়ায় তৈরি কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দামে কৃষিকাজে ব্যবহারযোগ্য এসব যন্ত্রাংশ বিক্রি হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল জাহাজ ভাঙার লোহা।

জানা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকে বগুড়ায় বিভিন্ন রকম যন্ত্রাংশের খুচরা পার্টস তৈরি হতে থাকে। বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় বিসিক শিল্প ও কাটনারপাড়াসহ বেশকিছু এলাকায় এসব যন্ত্রাংশ তৈরি হতে থাকে। একপর্যায়ে কারখানাগুলোর বিকাশ বেড়ে যাওয়ায় বগুড়া বিসিক শিল্প এলাকার প্লট শেষ হয়ে যায়। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান শহরের ফুলবাড়ি, গোহাইল রোড, রেলওয়ে মার্কেট, শাপলা মার্কেট, কাটনারপাড়া, চারমাথা এলাকায় গড়ে উঠেছে। এসব কলকারখানায় তৈরি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ ব্যবহার হয়ে থাকে বাসাবাড়ি, কারখানা ও কৃষিকাজে। দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প।

বগুড়া বিসিকের ফাউন্ড্রি শিল্প মালিক মিল্টন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. আজিজার রহমান মিল্টন জানান, আশির দশকে ব্যক্তি উদ্যোগে বগুড়াতেই প্রথম ফাউন্ড্রি শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ঢালাইনির্ভর প্রায় ১০০ শিল্প-কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ার ২৭টি কারখানায় অন্তত ৮০ ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। লোহা গলিয়ে বর্তমানে ১৬ ধরনের উন্নত যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। ফাউন্ড্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বেশকিছু ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। এসব ওয়ার্কশপে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত। এছাড়া এ অঞ্চলের আশপাশের অন্যান্য ওয়ার্কশপ মিলে প্রায় ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছে, যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে এ শিল্পে কাজ করেন।

বগুড়ার বিসিক কর্মকর্তারা জানান, ১৯৬৪ সালে শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় সাড়ে ১৪ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় বিসিক শিল্পনগরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই শেষ হয়ে যায় প্লটগুলো। উদ্যোক্তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে আরো ১৮ দশমিক ৬৭ একর জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু সেটির বরাদ্দও ১৯৯০ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এভাবে দুই দফায় মোট ২৩৩টি প্লটে ৮৫টি শিল্প ইউনিট গড়ে ওঠে। বর্তমানে সারা দেশে কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি এবং মেটাল শিল্প মালিকরা। শ্যালো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, যানবাহনের ছোট পার্টস, কলকারখানার প্রয়োজনীয় পার্টসসহ কৃষির সব যন্ত্রাংশ বগুড়ায় তৈরি হয়। কৃষির জন্য পাওয়ার টিলারের লোহার চাকা, শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, মেশিনের যন্ত্র পিস্টন, গজল পিন, লাইনার হেডপিট তৈরি হচ্ছে। এসব যন্ত্রাংশ বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়।

বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশের দোকান ঘুরে জানা যায়, একটি পাওয়ার টিলারের ফালাশেফের দাম ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা, লোহার চাকা ৩ হাজার টাকা, কাউন্টার পিনিয়াম প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা। পাওয়ার টিলারের একটি যন্ত্রাংশ ড্যানিশ বোর্ড ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা।

বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক জানান, বগুড়ায় ইঞ্জিন বাদে সব ধরনের পার্টস তৈরি হয়। এসব পার্টস দেশের প্রায় সব জেলায় কমবেশি বিক্রি হয়। জেলায় এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। আর প্রতি বছর লেনদেন হয়ে থাকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এখন সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণ দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

কার্টেসী: বণিকবার্তা

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button