সোশ্যাল মিডিয়া আর ব্লগিং দিয়েই যিনি গড়ে তুলেছেন বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান
২০১৪ সালে মাত্র চারটা বিউটি প্রোডাক্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তা এমিলি ওয়েইস। এখন তার ব্র্যান্ড ‘গ্লসিয়ার’ এর প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এমিলি এত বড় সাফল্য অর্জন করলেন কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির উপস্থিতির পিছনে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব এমিলি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। একেবারে নতুন অবস্থায় কোনো প্রোডাক্ট বাজারে আনার আগেই তার প্রতিষ্ঠান ‘গ্লসিয়ার’ এর ইন্সটাগ্রাম পেইজের ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজারেরও বেশি। আর এখন গ্লসিয়ার এর ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ারের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার পাশাপাশি এমিলি মূলত তার প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ব্লগের মাধ্যমে। ২০১০ সালে এমিলি শুরু করেন তার ব্লগ সাইট ‘ইনটু দ্য গ্লস’ (Into the Gloss)। সেখানে বিশেষ করে মেকআপ ও কসমেটিক্স নিয়ে নিয়মিত কন্টেন্ট তৈরি করতেন তিনি। এছাড়াও মেকআপ ও স্কিনকেয়ার নিয়ে কিম কার্ডাশিয়ান বা কার্লি ক্লসের মতো মডেলদের সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করতেন সেই ব্লগে। অবশ্য এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু মডেল আর তারকার সাথে কাজ করেছিলেন এমিলি নিজেই।
যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যে বড় হয়েছেন এমিলি। ১৮ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য নিউইয়র্কে যান। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডিও আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করার সময় ভোগ ম্যাগাজিনের অধীনেই ‘টিন ভোগ’ (Teen Vogue) নামের অনলাইন প্রকাশনা সংস্থায় ইন্টার্ন করেছিলেন। সেই সময় একটা টিভি শো’তে অল্প কিছুদিন অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। ব্লগিং শুরুর সময় তিনি ভোগ ম্যাগাজিনে ফ্যাশন অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করতেন।
সোশ্যাল মিডিয়া যখন জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে, তখনই বিউটি ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নেন এমিলি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, সেইসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটাতেই সোশ্যাল মিডিয়া এডিটর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। অথচ এমিলি বুঝতে পারছিলেন সাধারণ মানুষ আগের চাইতে বেশি ফ্যাশন সচেতন হয়ে উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার আর মেকআপ আর্টিস্টদেরকেই বেশিরভাগ মানুষ ফলো করছে। অন্যদিকে বড় বড় ব্র্যান্ডের ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে এখন আর কেউ মেকআপ করছে না। এই ধরনের কিছু বিষয় উপলব্ধি করেই এমিলি নিজের ব্লগ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফ্যাশন সচেতন মানুষরা এমিলির ব্লগ ফলো করা শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যে এমিলির ব্লগ পেইজে প্রতি মাসে প্রায় দুই লক্ষ ভিজিটর কাউন্ট করা হচ্ছিল। সেই সময়ে ব্লগ থেকে আয় হলেও তিনি ব্লগিং এর পাশাপাশি ভোগ ম্যাগাজিনেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। তবে যখন প্রতি মাসে তার ব্লগের পেইজ ভিউয়ের সংখ্যা ১০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেল, তখনই তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম ব্লগিং শুরু করলেন।
২.
ব্লগের মাধ্যমে এমিলি ফ্যাশন আর মেকআপ নিয়ে আগ্রহী মানুষদের ব্যাপারে আরো পরিষ্কারভাবে জানতে পারলেন। তিনি তাদের চাহিদা আর মনোভাবের বিষয়গুলি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। ফলে, গ্রাহকদের চাহিদা বিবেচনা করে মেকআপ আইটেম বাজারে আনতে ২০১৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘গ্লসিয়ার’।
প্রাথমিক অবস্থায় বিনিয়োগ সংগ্রহ করার জন্য এমিলি ওয়েইস অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে, এমন প্রায় ১১টা সংস্থার কাছে গিয়েও তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন। ১২ তম প্রচেষ্টার পরে অবশেষে তিনি ২ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন। কিন্তু এরপরে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সফল হওয়ার পরে অবশ্য অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্যে এগিয়ে এসেছে আর এখনো আসছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে গ্লসিয়ার এর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, তারা ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে পেরেছে।
বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়াও মেকআপ নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনার চেষ্টা করছে গ্লসিয়ার। প্রতিষ্ঠার সময় গ্লসিয়ার এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এর প্রোডাক্ট ব্যবহার করলে গ্রাহকরা মেকআপ করলেও তাতে ‘নো-মেকআপ লুক’ আসবে। নতুন ধরনের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকেই পছন্দ করেছেন। তাছাড়াও গ্রাহকদের সুবিধা আর মতামতের ওপর ভিত্তি করে গ্লসিয়ার এখন পর্যন্ত সুবিধাজনক আর কার্যকরী অনেক প্রোডাক্ট এনেছে।
গ্লসিয়ার এর সিএফও হেনরি ডেভিস এই বিষয়ে বলেন, “অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, আমরা খুব ভালো করেই জানি আমাদের গ্রাহক কারা।” তিনি বিশেষ করে গ্লসিয়ার মিল্কি জেলি ক্লিনজার নামের একটা প্রোডাক্টের ব্যাপারে বলেন। মেকআপ ধোয়ার ক্ষেত্রে মানুষরা সাধারণত দুই ধরনের প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন। প্রথমে মেকআপ রিমুভার আর এরপরে ফেসওয়াশ। গ্লসিয়ার এর এই ক্লিনজার একইসাথে এই দুইটা প্রোডাক্টের কাজ করে। ডেভিসের মতে, প্রতিষ্ঠিত কোনো মেকআপ বা স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড এই প্রোডাক্টটা আনবে না। কারণ, এতে করে তাদের পণ্যের সংখ্যা কমে যাবে। তবে গ্লসিয়ার ব্যাপারটা সেভাবে দেখে না। গ্রাহকদের সুবিধা নিশ্চিত করেই গ্লসিয়ার জনপ্রিয় হতে চায়।
গ্রাহকদের কমিউনিটির ওপর গ্লসিয়ার এর সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে। ইন্সটাগ্রামের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারের মতো বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে প্রতিষ্ঠানটির বড় কমিউনিটি আছে। মূলত সেইসব কমিউনিটি মেম্বাররাই গ্লসিয়ার এর প্রোডাক্ট নিজে কেনেন আর পরিচিতদেরকেও কিনতে উৎসাহিত করেন।
৩.
মূলত অনলাইনে ব্যবসা করলেও গ্লসিয়ার এর বেশ কয়েকটা পপ-আপ স্টোর আছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কানাডা, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক ও ফ্রান্সে নিজেদের প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিচ্ছে।
সফল হওয়ার পেছনের গল্পটা কী, একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এমিলিকে। তিনি বলেছিলেন, “আমি কী করছি, সেই সম্পর্কে প্রথমদিকে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। একদিন ব্যবসা করার জন্য যা যা লাগবে, তার লিস্ট করা শুরু করি। সেখান থেকেই শুরু।”
এমিলির মাথায় হঠাৎ ব্যবসা করার চিন্তা আসে বলেই তিনি আজকে বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সিইও। তার প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা বিখ্যাত সংস্থার পক্ষ থেকে সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। গত বছর টাইম ম্যাগাজিনের ‘নেক্সট ১০০’ এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল তার প্রতিষ্ঠান গ্লসিয়ার। যেই প্রতিষ্ঠানে তিনি ইন্টার্ন করেছিলেন, সেই ‘টিন ভোগ’ (Teen Vogue) ছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে তার প্রতিষ্ঠানকে ‘টপ বিউটি ব্র্যান্ড’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সেইসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে গ্ল্যামার, নাইলন, কসমোপলিটন, অ্যালিউর এবং উইমেন্স ওয়্যার ডেইলি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাগাজিন ইনক (Inc.) এর পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে ‘ডিজিটাল ইনোভেটর অফ দ্য ইয়ার’ এবং ২০১৭ সালে ‘কোম্পানি অফ দ্য ইয়ার’ এর স্বীকৃতি পায় গ্লসিয়ার।
যারা এখনো ভাবছেন ব্যবসা করলে সফল হতে পারবেন কিনা, তাদের জন্য এমিলি ওয়েইস অনুপ্রেরণা জাগানোর মতো একজন মানুষ। সফলতা অর্জন করতে চাইলে কখনোই নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাবেন না। লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারলে আপনিও হতে পারবেন সফল একজন ব্যবসায়ী।
ব্যবসার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে আপনি কী মনে করেন? কমেন্টে আপনার মতামত আমাদেরকে জানান।