বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের দর্শনীয় স্থান

উত্তরবঙ্গ হল বাংলাদেশের ভৌগলিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগ কে একত্রে বলা হয় উত্তরবঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের ভৌগলিক নাম উত্তরবঙ্গ থেকেই এই নামের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এই অংশ টা সমগ্র বাংলাদেশের উত্তরে বলেই, উত্তরবঙ্গ বলা হয়ে থাকে। রংপুর বিভাগ গঠন করার পূর্বে, পুরো উত্তরবঙ্গই রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ছিল। মোট ১৬ টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা উত্তরবঙ্গের প্রবেশ দ্বার এবং বগুড়া শহরকে উত্তরবঙ্গের রাজধানী বলা হয়।
আসুন জেনে নেই উত্তরবঙ্গের কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কেঃ
বগুড়াঃ
বগুড়া বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার একটি শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর। উত্তরবঙ্গের প্রাণ কেন্দ্র নামে পরিচিত বগুড়াকে ঐ এলাকার রাজধানী বলেই সবার কাছে জানা। বগুড়া শহরের ১১ কি.মি. অদূরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। এখানে পূর্বে রাজা পশুরামের রাজ্য ছিল। এখানে বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর ও গোবিন্দ ভিটা রয়েছে; আছে জাদুঘরও। এছাড়া মাজার শরীফ, কাটাবিহীন বড়াইয়ের গাছ, পশুরামের প্রাসাদ ও প্রাচীর, গোবিন্দভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বেহুলার বাসরঘর, শিলা দেবীর ঘাট, ভাসুবিহার, বাংলাদেশের একমাত্র মশলা গবেষণা কেন্দ্র দেখতে আসেন অসংখ্য ভ্রমণকারী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জঃ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের খ্যাতি বাংলাদেশ ব্যাপি। ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলো চাইলে আমের মৌসুমে সেখানে আম বাগানে গিয়ে পাকা আম খেতে পারবে এছাড়াও বিলভাতিয়া, বিলচুড়াইল, বিলহোগলা, ছোট সোনা মসজিদ, দাসবাড়ি মসজিদ যে কারো নজর কারবে।নানান দর্শনীয় স্থানে সমৃদ্ধ উত্তরের জেলা রাজশাহী। আর বরেন্দ্রভূমির রাজধানী হিসাবে খ্যাত রাজশাহী বরাবরই ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। বরেন্দ্র জাদুঘর, পুটিয়া রাজবাড়ী, সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভদ্রাপাক, পদ্মার চর পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
নাটোরঃ
নাটোরের কাচাগোল্লা খেতে কার না মন চায়। তার সাথে দেখতে পাবেন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী, নাটোরের রাজবাড়ী, চৌগ্রাম জমিদার-বাড়ী।
সিরাজগঞ্জঃ
যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ জেলাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। বেলকুচির তাতিদের তাত পল্লী ও তাদের তাঁত শিল্প, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বাড়ী, দরগাহ মসজিদ, শিব মন্দির ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করবে।
জয়পুরহাটঃ
জয়পুরহাট বহু দিন গৌড়ের পাল ও সেন রাজাদের রাজ্য ভূক্ত ছিল। আছা রাঙ্গাদিঘী, নান্দাইল দিঘী, লাকমা রাজবাড়ী, পাথর ঘাটা দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
পাবনাঃ
হাওর-বাওর ও বিল দিয়ে সাজানো পাবনা জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলন বিলের একটা অংশ এই জেলাকে ঘিরে। বর্ষার সময় ভরা বিলে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা ও টাটকা মাছ দিয়ে খাবার খাওয়া এক নতুন অনুভূতির যোগান দেবে। এছাড়া পাকসি, ঈশ্বরদীর চিনির কারখানা দেখার সু্যোগ থাকবেই।
গাইবান্ধাঃ
কথিত আছে রাজা গোবিন্দের ষাট হাজার গরুর গো-চরণভূমির নামে গাইবান্ধা জেলার নামকরণ হয়েছে। গাইবান্ধা জেলায় পর্যটকদের মনকাড়ার মতো অনেক জায়গা আছে তার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ এর কুটিবাড়ী, পলাশবাড়ী এডুকেশন পার্ক, ড্রীমল্যান্ড পার্ক, মাটির নিচে সবুজ ঘর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কাষ্ট কালীর মন্দির, বালাসী ঘাট, যমুনার চরগুলো।
রংপুরঃ
রংপুর জেলা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা, যা রংপুর বিভাগের অন্তর্গত। রংপুরজেলার ভিন্নজগৎ, বেগম রোকেয়ার বাড়ী, নীলদরিয়াবিল, তাজহাট জমিদারবাড়ী, রংপুর চিড়িয়াখানা, চিকলী বিল বিনোদনের কেন্দ্র হিসাবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছে।
দিনাজপুরঃ
দিনাজপুরের লিচুর স্বাদ এক কথায় অতুলনীয়। বাংলাদেশের লিচুর রাজধানী দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, রামসাগর দিঘীর সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের বিমোহিত করবে।
ঠাকুরগাওঃ
ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু স্থান পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে শুরু করেছে। এখানকার গ্রামগুলো ছবিতে আঁকা চিত্রের মতো। কুমিল্লা হাড়িপিকনিক কর্ণার, খুনিয়া দিঘীতে লোক সমাগম দিন দিন বেড়েই চলেছে।ঠাকুরগাঁও জেলায় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আছে। সেগুলো হচ্ছে ঢোলহাট মন্দির ও জামালপুর জামে মসজিদ।এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে হরিপুর রাজবাড়ি, রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি, বাংলা গড়, জগদল রাজবাড়ি, ঢোলারহাট শিব মন্দির, গড়গ্রাম দুর্গ প্রভৃতি।
নীলফামারীঃ
নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। এটি রংপুর বিভাগের আটটি জেলার একটি অন্যতম সীমান্তঘেষা জেলা।এক সময় বৃটিশরা এখানকার চাষীদের বাধ্য করতো নীল চাষ করতে। এই জেলার প্রত্যেকটি স্থান এক একটি ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস জানার পাশাপাশি ভ্রমণকারীরা দেখতে পারবেন নীলসাগর, ধর্মপালের গড়,তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প, কুন্দুপুকুর মাজার, হযরত শাহ কলন্দর মাজার, হরিশচন্দ্রের পাঠ, ময়নামতির দূর্গ, ভীমের মায়ের চুলা,চীনা মসজিদ, সৈয়দপুর চার্চ, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা, দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল, উত্তরা ইপিজেড, সৈয়দপুর বিমানবন্দর, ডিমলা রাজবাড়ী, বালাপাড়া গণকবর ইত্যাদি।
কুড়িগ্রামঃ
কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরে লালমনিরহাট জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা, দক্ষিণে গাইবান্ধা জেলা, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ধুবড়ী জেলা ও দক্ষিণ শালমারা মানকার চর জেলা এবং পশ্চিমে লালমনিরহাট জেলা ও রংপুর জেলা অবস্থিত। মহা রাজা বিশ্বসিংহের কুড়িটি পরিবারের দেশ থেকেই কুড়িগ্রাম জেলা। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া শাহী মসজিদ, বীর প্রতীক প্রাপ্ত তারামন বিবিরবাড়ী, নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ী, চিলমারী বন্দর পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
লালমনিরহাটঃ
লালমনিরহাট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল লালমনিরহাট জেলায় যা আজ বিলুপ্ত। ছিটমহলগুলোর বৈশিষ্ট আলাদা দেখে মনে হবে বাংলাদেশের মাঝে আরেকটি ছোট্ট বাংলাদেশ। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা যোগ করতে পারবেন। তিস্তা সেচ প্রকল্প, প্রাচীন লালমনিরহাট বিমান বন্দর, শালবন, হাতিবান্ধা, বুড়িমাড়ি জিরো পয়েন্ট, তিনবিঘা করিডর, সিন্দুর মতির দীঘি, কবি শেখ ফজলুল করিমের বসত ভিটা, তিস্তা ব্যারেজ, কাকিনা জমিদার বাড়ি, বোতল বাড়ি (কালীগঞ্জ- নওদাবাস),কালিবাড়ি মন্দির (পাশাপাশি স্থাপিত মসজিদ ও মন্দির), তুষভাণ্ডার জমিদার বাড়ি, ঐতিহ্যবাহী সিন্দুরমতি মন্দির,৬৯ হিজরীর হারানো মসজিদ।
পঞ্চগড়ঃ
পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলা। যেমনি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তেমনি অসাধারণ অতিথিপরায়ণ মানুষের বসতি, চা-বাগানে সমৃদ্ধ, পাথর দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন এই জেলাকে। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের অধিকারী এই জেলার মানুষেরা। ভারতের সাথে সীমান্ত সংযোগ এখানকার অর্থনীতিকে করেছে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হিমালয়ের কন্যা পঞ্চগড় যেন হিমালয়ের কৃপার দান। বাংলাবান্ধা পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠেছে অন্যরকম আবেদনের জায়গা হিসাবে।
উত্তরবঙ্গের পর্যটনের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রয়োজন শুধু প্রচার-প্রসার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমগুলো যদি উত্তরবঙ্গ পর্যটন স্থাপনা ও স্থানগুলোকে প্রচার-প্রসারে কাজ করে তাহলে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের নতুন একটি দিগন্তের উন্মোচন হবে। বেড়ে যাবে অথনৈতিক সমৃদ্ধি। কমিউনিটি ভিত্তিক ট্যুরিজমের মাধ্যমে কমানো সম্ভব হবে স্থানীয়দের বেকার সমস্যা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের পর্যটন সহায়ক মনোভাব বদলে দিতে পারে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের উন্নয়নের দুয়ার।