ধর্ম

রমাদানের প্রস্তুতি গ্রহণের পদ্ধতি ও রমাদান সার্থক করার উপায়

রমাদান মানবজাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার অন্যতম অনুগ্রহ। এই মাসকে আল্লাহ অন্য মাসসমূহের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। একে অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছেন। রমাদান রহমত, বরকত, নাযাত, মাগফিরাত ও বহুবিধ কল্যাণের মাস হিসেবে পরিগণিত।

যেকোনো বিষয়ের মর্যাদাবোধে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য জরুরি হলো তার মর্যাদা সম্পর্কে জানা। এজন্য আমরা শুরুতে রমাদানের মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করছি।

যেসব কারণে এই মাসটি শ্রেষ্ঠ, তার অন্যতম কয়েকটি হলো—

কুরআন নাযিলের মাস: আল্লাহ তাআলা মুসলিম মিল্লাতের ওপর যত অনুগ্রহ দান করেছেন, কুরআনুল কারীম তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ। কুরআন যেকোনো জাতির উন্নতি ও অবনতির মাপকাঠি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন— আল্লাহ তাআলা এই কুরআনের মাধ্যমে কোনো জাতিকে উন্নতি দান করেন আর কোনো জাতির অবনতি ঘটানো।

উন্নয়নের চাবিকাঠি এই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছেন রমাদান মাসে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেন— রমাদান মাস, যাতে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং সত্যাসত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।

জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা এবং শয়তানকে আবদ্ধ করার মাস: রমাদানুল কারীমের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ও ফযীলত হলো, এই মাসটিই একমাত্র মাস, যে মাসে আল্লাহ তাআলা তিনটি বিশাল বড় ফযীলত এবং মর্যাদা রেখেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন—যখন রমাদান আসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়।

ক্ষমা ও মুক্তির মাস: রামাদানুল কারীম ঈমানদারের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে ক্ষমা লাভের, জাহান্নাম থেকে নাজাত এবং মুক্তি লাভের এক বিশেষ অফারের মাস। আল্লাহ তাআলার দেয়া সারা বছরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অফারের মুহূর্ত হলো রমাদানুল কারীমের মুহূর্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— আল্লাহ তাআলা (রমাদানের) প্রত্যেক দিনে এবং রাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।

আমলের সাওয়াব বর্ধিত করার মাস: রামাদানুল কারীম মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে প্রত্যেকটি আমলের বিনিময়ে অনেক বর্ধিত দিয়ে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বনী আদমের সকল নেক আমলের বিনিময় দশগুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম। সিয়াম আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব।

তাকওয়ার মাস: আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমাদান দান করেছেন, আমাদেরকে মুত্তাকী বানানোর জন্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন— তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।

উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা বুঝতে পারলাম, রমাদান কুরআন নাযিলের মাস, জান্নাতের দরজা উম্মুক্ত হওয়া, জাহান্নাম বন্ধ করে দেওয়া এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখার মাস, আমলের সাওয়াব বর্ধিত করার মাস। সর্বোপরি এটি তাকওয়ার মাস। এক কথায় এটি ইবাদতের উপযোগী পরিবেশ করে দেওয়ার মাস।

এই মাসের আমলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো সিয়াম। সিয়ামের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারের সময়, আরেকটি তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। আর সিয়াম পালনকারীর মুখের (পাকস্থলিজাত) দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও বেশি পবিত্র

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের জন্য রমাদানের সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন— জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারী ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।

সিয়ামের মর্যাদা বোঝার জন্য আরও একটি বিষয় লক্ষ করতে পারি, তা হলো, সিয়াম ইসলামের মূল পাঁচ আরকানের একটি।

প্রত্যেক ব্যবসায়ী ব্যবসার সিজনের জন্য মুখিয়ে থাকে। ব্যবসার সিজন হাতছাড়া করতে চায় না, ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় কসুর করে না। তদ্রূপ রমাদান ঈমানদারদের নেকি অর্জনের সিজন। ঈমানদারদেরও উচিত রমাদানকে নেকি অর্জন ও গুনাহ মাফের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া না করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে এই বরকতময় মাসটি অবহেলায় কেটে যায়, যথাযর্থ মর্যাদা দেওয়া হয় না, পর্যাপ্ত আমল করা হয় না। কাজেই আমাদের উচিত রমাদের আগে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

রমাদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের প্রচলিত পদ্ধতি বনাম সঠিক পদ্ধতি

রমাদানুল কারীমের কল্যাণ লাভ করতে হলে আগে থেকে তার জন্য যথাযোগ্য প্রস্তুতি থাকা দরকার। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভালো প্রস্তুতি মানে কাজটার অর্ধেক পূর্ণতা। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বা বড় কাজ করার আগে যদি ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে কাজটা ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায়। এজন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রদেয় রমাদানুল কারীমের বিশাল অফার পেতে শা’বান থেকে সর্বোত্তম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের সমাজে রমাদান মাসকে বরণ করার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়, দুঃখজনকভাবে সেটি রমাদানের আহ্বানের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং অনেকখানি সাংঘর্ষিক। আমাদের দেশে রমাদানকে স্বাগত জানানোর প্রচলিত পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ:

সরকারের প্রস্তুতি: আমাদের দেশের সরকার রমাদান উপলক্ষে অতিরিক্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি করে। ছোলা, চিনি, বেসন, খেজুর, চাল, আটা ও সয়াবিন অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে অতিরিক্ত পরিমাণ মজুদ রাখার চেষ্টা করে। এদেশে রমাদানের আগে যে পরিমাণ লোক ছিল, রমাদানে কি তারচেয়ে বেড়ে যায়? তা না-হলে রমাদানের জন্য খাদ্যপণ্য বেশি মজুদের প্রয়োজন কেন হয়? প্রতি বছর রমাদানে বাজারে হাহাকার শুরু হয়, মানুষ সংশ্লিষ্ট  মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা শুরু করে দেয়। এর কারণ রমাদানে মানুষ খাবার বেশি খায়। ভাবখান এমন, রমাদানের প্রস্তুতি মানে খাবারের প্রস্তুতি। এটি রমাদানের জন্য প্রস্তুতির ভুল পদ্ধতি।

ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি: আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত খাদ্য গুদামজাত করে বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করে। এর ফলে রমাদানে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এটা অসাধু ব্যবসায়ীদের রমাদানের প্রস্তুতি।

রাজনীতিকদের প্রস্তুতি: রমাদান মাসে মিছিল-মিটিং করা যায় না, প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে। এজন্য তারা ইফতার পার্টির মাধ্যমে এর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। এজন্য রমাদানের আগে থেকে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে।

সাধারণ মানুষের প্রস্তুতি: আমাদের তথা সাধারণ মানুষের রমাদানের প্রস্তুতি হলো, রমাদানের বিশদিন আগে থেকে রমাদান উপলক্ষে অতিরিক্ত সয়াবিন তেল, ছোলা, খেজুর, বেগুন, বেসন ও কাপড়-চোপড়সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখি। এটাই আমাদের রমাদানের প্রস্তুতি।

মিডিয়া অঙ্গনের প্রস্তুতি: আমাদের দেশের মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত যথা: টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও সিনেমা নির্মাতাদের রমাদান কেন্দ্রিক প্রস্তুতি হলো, ঈদ কেন্দ্রিক নাটক, সিনেমা ও অনুষ্ঠান নির্মাণ করা। এটা তাদের রমাদান উপলক্ষে প্রস্তুতি। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ঈদের নাটক কোনদিন কোনটি দেখাবে, তার আগাম ঘোষণা দেয়া শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এটাই তাদের রমাদানের প্রস্তুতি।

আল্লাহ আমাদের মাফ করুন, এসব রমাদানের যথাযথ প্রস্তুতি নয়। আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের রমাদান কেন্দ্রিক প্রস্তুতি দেখলে মনে হয়, রমাদান এসেছে খাওয়ার জন্য। অথচ রমাদান ত্যাগের মাস, ইবাদতের মাস।

রমাদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি

কাজেই রমাদানকে সুন্দরভাবে কাটানোর জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ভুল পদ্ধতিতে রমাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করলে এর ফযীলত থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এজন্য একনজরে রমাদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পদ্ধতিগুলো বর্ণনা করছি। তদনুযায়ী আমল করে রমাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে।

১. তাওবা এবং ইস্তিগফার করা: যে ব্যক্তি আল্লাহর কাঠগড়ায় আসামি, যার নামে আগে থেকে আল্লাহর আদালতে মামলা রয়েছে, তার জন্য নতুনভাবে নেক আমলের তাওফিক পাওয়া একটু কঠিন। এজন্য আগের অপরাধের জন্য তাওবা করে রমাদানের আগে নতুনভাবে জীবন গড়ার সংকল্প করতে হবে। পেছনের সমস্ত গুনাহর জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে।

রমাদানের ফযীলত সম্পর্কে সচেতন হওয়া: কুরআন ও সুন্নাহে রমাদানের যেসব ফযীলত ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো এখন থেকে বেশি বেশি করে পড়তে হবে, শুনতে হবে, বলতে হবে, চর্চা করতে হবে; প্রয়োজনে ঘরে লিখে রাখতে হবে, যাতে বারবার দেখে উৎসাহিত হতে পারি। তাহলে রমাদানের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে পারব, রমাদানে আমল করার গুরুত্ব নিজের মধ্যে বদ্ধমূল হবে।

ক্ষমা লাভের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া: ক্ষমা এবং সাওয়াব লাভের জন্য মানসিকভাবে এই মর্মে দৃড় প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, এই বছর রমাদানটা ব্যতিক্রমভাবে কাটাব। জীবনের শেষ রমাদান মনে করে ভালোভাবে কাটানোর জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

. কাযা রোযা আদায় করা: বিগত কোনো রমাদানের রোযা কাযা হয়ে থাকলে, রমাদানের আগে আগে সেগুলো আদায় করে শেষ করার চেষ্টা করতে হবে।

. হিংসা ও শিরক থেকে মুক্ত হওয়া: আল্লাহ তাআলার সাধারণ ক্ষমা লাভের জন্য হিংসা এবং শিরক থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক। সেজন্য নিজেদেরকে রমাদান আসার আগে আগে হিংসা এবং শিরক থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

. রমাদানের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল জেনে নেয়া: রমাদান এবং সিয়াম সংক্রান্ত মাসআলা বইপুস্তক পড়ে, বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে শুনে শিখে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে; জেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

. বিগত রমাদানের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করা: বিগত রমাদানগুলো কী কী কারণে ভালোভাবে যাপন করা হয় নি, সে কারণগুলোকে চিহ্নিত করে নিজের মধ্য থেকে দূর করতে হবে। আগে থেকে সাবধান হতে হবে, যাতে সামনের রমাদানও যেন বিগত রমাদানের মতো গাফিলতিতে কেটে না যায়, বিগত বছরের ভুলগুলো যেন এ বছরও না হয়।

. আগে থেকে রমাদানের বিশেষ আমলের অভ্যাস করা: রমাদান উপলক্ষে বিশেষ কিছু আমল আছে, সেগুলো যেন করতে পারি, এখন থেকে তার একটা মহড়া এবং প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। দান বা অন্যান্য আমলগুলো এখন থেকে টুকটাক শুরু করতে হবে, যাতে অভ্যাস তৈরি হয়।

. রমাদানের জন্য রুটিন তৈরি করা: রমাদানের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য এখন থেকে সারাদিনের রুটিন তৈরি করতে হবে, যাতে কোন্ সময় কী করব এখন থেকে প্রস্তুতি নিয়ে নিতে পারি।

১০. রমাদানের চাঁদ দেখা: শুধু চাঁদ দেখা কমিটির দিকে না তাকিয়ে শাবানের ২৯ তারিখে পশ্চিম আকাশে রমাদানের চাঁদ তালাশ করব। চাঁদ দেখলে দোয়া করব। যদি চাঁদ দেখতে না-ও পারি, চেষ্টা করার বদৌলতে সাওয়াব পাব ইন-শা-আল্লাহ।

১১. রমাদানের ভালোভাবে কাটানোর দোয়া করা: আরেকটা প্রস্তুতির বিষয় হলো, রমাদান উপলক্ষে আল্লাহর কাছে এই মর্মে দোয়া করা— আল্লাহ, আমাকে রমাদান ভালোভাবে কাটানোর তাওফিক দান করুন। আল্লাহ, এই একটা রমাদান যেন আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

রমাদান সার্থক করার জন্য কয়েকটি পরামর্শ

উপরে আমরা আলোচনা করছি, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমাদানুল কারীম এবং সিয়াম দিয়েছেন মুত্তাক্বী বানানোর জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সিয়াম আমাদেরকে মুত্তাক্বী বানাচ্ছে কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সিয়ামের কোনো প্রভাব পড়ছে কি? শুধু ইফতার ও সাহরী খাওয়া এবং বড়জোর তারাবীহ আদায় করা— এই তিনটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই যদি আমার সিয়াম শেষ হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সিয়ামের বিধান আরোপ করেছেন, আমার সিয়াম সেই উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয় নি। কিছু বিষয় মেনে চলতে পারলে ইন-শা-আল্লাহ আমাদের সিয়াম সার্থক হবে।

১. হারামের সংশ্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখা: রাসূল (সা.) বলেছেন— নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকো, তাহলে তুমি মানুষের মধ্যে সবচে বড় ইবাদতগুজার হিসাবে গণ্য হবে।

আল্লাহ তাআলা সিয়ামের বিধান এজন্য আরোপ করেছেন যে, যেভাবে আমরা রমাদানের দিনের বেলা পানাহার নিজের ওপর হারাম করেছি, তদ্রূপ যেন আল্লাহ-কর্তৃক অন্যান্য সকল নিষিদ্ধ বিষয়ও হারাম জ্ঞান করে বর্জন করি। তা যদি করতে পারি, তাহলে আমার সিয়াম সার্থক। যারা সিয়াম পলন করছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন নেই, তাদের কাজ-কর্মে কোনো পার্থক্য আসে না, হারামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় না, অবৈধ উপার্জন অব্যাহত আছে, টেলিভিশনে-মোবাইলে হারাম কন্টেন্ট দেখে— তাহলে তার সিয়াম ব্যর্থ; তা নিছক উপবাস ছাড়া কিছুই নয়।

সিয়াম থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত আমরা সবাই একান্ত নিষ্ঠা ও ইখলাসের সাথে সিয়াম পালন করি। আপনি যখন একাকী থাকেন, আপনার কাছে কেউ থাকে না, প্রচণ্ড ক্ষুধা সত্ত্বেও আপনি কিছু খান না। কেন খান না? কারণ আল্লাহ দেখছেন। যে আল্লাহর ভয়ে আপনি রমাদানের দিনের বেলা পানাহার ত্যাগ করলেন, সে আল্লাহর ভয়ে কেন অন্যান্য হারাম কাজ ত্যাগ করছেন না? আপনি যখন ফিল্ম দেখেন, মোবাইলে গান শোনেন, হারাম কন্টেন্ট দেখেন তখনও তো আল্লাহ দেখেন। তাহলে সেসব হারাম কাজ কেন করেন? সিয়াম থেকে যদি আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, এই মাসে আমাদের চরিত্র বদলে ফেলব— তাহলেই আমাদের সিয়াম পালন সার্থক হবে। আমাদের রমাদান সার্থক হবে।

২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করা: বিশেষ করে রমাদানের দিনগুলোতে এ ব্যাপারে বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। এর সহজ উপায় হলো আযানের সাথে সাথে মসজিদে চলে যাওয়া। নবী কারীম সা. বলেছেন— কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দাদের থেকে সালাতের হিসাব নেয়া হবে। সালাত যথাযথভাবে আদায় হয়ে থাকলে সে সফল হবে ও মুক্তি পাবে। সালাত যথাযথ আদায় না হয়ে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হবে।

মহিলারা বাসা-বাড়িতে প্রথম ওয়াক্তে, ধীরস্থিরভাবে সালাত আদায় করবেন।

৩. কুরআন তিলাওয়াত করা: রমাদান কুরআন নাযিলের মাস। কাজেই এই মাসে অধিক পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। তিলাওয়াতের সময় আয়াতের অর্থ, প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা অনুধাবনের চেষ্টা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে পানাহার ও জৈবিক কর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে  আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ তখন তাদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।

৪. ইসলামী জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা: ব্যক্তিগতভাবে এবং পরিবারকে সাথে নিয়ে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট থাকা যেতে পারে। আমলের মাস রমাদানে এর অভ্যাস করে ফেলতে পারলে সারা বছর এর প্রভাব থাকবে ইন-শা-আল্লাহ।

৫. দোয়া এবং তাহাজ্জুদে মনোনিবেশ করা: রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন— কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব

রমাদানে আমরা সবাই সাহরী খাওয়ার জন্য ভোররাতে ঘুম থেকে উঠি। খাবার প্রস্তুত হতে যতক্ষণ লাগে, আমরা চাইলেই এর মধ্যে কয়েক রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ে ফেলতে পারি। অথচ আলস্য বশত আমরা ফযীলতপূর্ণ সময়টা অহেতুক কাটিয়ে দিই।

আমাদের এ সিয়াম তখনই উপকার বয়ে আনবে, এ সিয়াম তখনই সার্থক হবে, যদি আমরা তাকওয়ার পথে অগ্রসর হতে পারি, গাইডলাইন মেনে চলতে পারি। সুতরাং আসুন, রামাদানুল কারীমকে আমাদের জীবনের সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করি এবং এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত নেক আমলে ব্যায় করার চেষ্টা করি, বদ আমল থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কুরআন এবং সুন্নাহর প্রদর্শিত পথ এবং পদ্ধতি অনুসারে আমলের মাধ্যমে আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের আমরা চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

লেখক: শায়খ আহমাদুল্লাহ

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button