বগুড়া জেলা

হাতে তৈরী গহনায় সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা কান্তা চক্রবর্তী


হাতে তৈরি গহনা বা যে কোনো জিনিসে ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে। এই অনুভূতির প্রতি ছোটবেলা থেকে ভালো লাগা কাজ করত। একটা সময় এই ভালো লাগাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা কান্তা চক্রবর্তী। অনলাইন বা অফলাইনে নিজের পন্য শুধু বগুড়ায় নয়, রাজধানীতেও ব্যাপক সমাদৃত।


হস্তশিল্প নিয়ে শুধু নিজেই আয় করছেন না তরুণ এই নারী উদ্যোক্তা। শখ, সংসার সামলে পাশাপাশি চাকরি করছেন মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের জেলা অফিসে কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর পদে। সেখানেও নিত্যদিন নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে।


বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার চাঁপাপুরের মেয়ে কান্তা চক্রবর্ত্তী। লেখাপড়া করেছে সরকারি আজিজুল হক কলেজে। বর্তমানে বসবাস করছেন শহরের ফুলবাড়ি এলাকায়। ২০১৫ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে নারী বিষয়ক অধিদফতরে যোগদান করেন। অবশ্য এর আগে থেকেই তিনি বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পে নিজের মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।


কান্তা চক্রবর্তী জানান, হাতে তৈরি জিনিসের প্রতি ছোটবেলা থেকেই এক আকর্ষণ অনুভব করতাম। শুরুটাও করেছিলাম কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে হাতে তৈরি বুটিকস পণ্য নিয়ে। অ্যাপ্লিক্স, পোশাক তৈরির কাজ করছিলাম। কিন্তু সেই টিমটা ভেঙে যাওয়ায় একটা বিরতি পড়ে।
এই উদ্যোক্তার ভাষায়, হাতে তৈরি গহনার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে, যা মেশিনে তৈরি গহনায় পাওয়া যায় না। এটি কেবল একটি পণ্য নয়, বরং সৃজনশীলতার প্রকাশ। হাতে তৈরি গহনা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই, যা আমার মূল দর্শনের সঙ্গে মেলে। কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর পদে চাকরিতে ঢোকার কয়েকবছর নিজের মূল শখের জায়গায় আবার ফিরে আসি।


‘প্রথমে নিজের জন্য কিছু গহনা অনলাইন থেকে কিনে সেগুলো খুলে দেখি, সেখান থেকে কিছু আইডিয়া এবং ইউটিউব থেকে কিছু আইডিয়া নিয়ে আমি প্রথম গয়না বানাই। আশেপাশের মানুষদের প্রশংসা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিই। সে সময় মাত্র ১৮০০ টাকা মূলধন নিয়ে আমি এই কাজ শুরু করি।’


সময় টা ২০১৮ সাল, বলছিলেন কান্তা চক্রবর্তী। ওই সময় তার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শে নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লেজ’ ইংরেজি `klaze’ চালু করেন। নামকরণ সম্পর্কে কান্তা বলেন, এই নামের আলাদা কোনো অর্থ নেই। তবে এর সঙ্গে আমার ও আমার স্বামীর পূর্বপুরুষদের স্পর্শ রয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে এই নামটি আমরা ঠিক করি। পরে ২০১৯ সালে পুরোদমে ‘ক্লেজ’ যাত্রা শুরু করে। এরপর গহনা তৈরিকে ব্যবসায় রূপ দিলাম।


গত পাঁচ বছরে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছিল। এরমধ্যে মহামারী করোনাভাইরাস অন্যতম। কান্তা চক্রবর্তী নিজেও দুবার আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কান্তা জানান, করোনায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম। তবে অনলাইন প্লাটফর্ম সে সময় ভালো সুবিধা পেয়েছিলাম। ব্যবসার পরিচিতও পায়। পাঁচ বছরে এখন ‘ক্লেজ’ নিয়ে আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী।


আমার পণ্যের বিশেষত্ব হলো প্রতিটি পণ্য হাতে তৈরি, যা ইউনিক ও পরিবেশবান্ধব। আমরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড পণ্য তৈরির সুযোগও দিচ্ছি। ফলে গ্রাহকরা একটি ব্যক্তিগত টান অনুভব করেন।


এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, সম্প্রতি ঢাকার ধানমন্ডি ও নুরজাহান রোডে দুটো আউটলেটে আমার তৈরী পন্যগুলো নিয়মিত সরবরাহ করছি। এ ছাড়া আরও কয়েক জেলায় আমার পন্য যাচ্ছে। এখন বছরে গড়ে ২.৫ থেকে ৩ লাখ টাকার পন্য বিক্রি হচ্ছে।


কান্তা চক্রবর্তী বিভিন্ন সময়ে দেশি বিদেশি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সর্বশেষ ইউএস অ্যাম্বেসির অর্থায়নে ব্রাকের একটি প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক বছরের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণে সারাদেশে ৯০ জনকে সিলেক্ট করে সংস্থাটি। এতে বগুড়ার মধ্যে কান্তা চক্রবর্তীই নির্বাচিত হয়েছিলেন।


ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কান্তা বলেন, আমার স্বপ্ন ‘Klaze’কে এমন একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করা যা শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হবে। পাশাপাশি আরও অনেক নারীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে চাই। আগামী বছরে ক্লেজের একটি নিজস্ব প্রডাকশন হাউজ তৈরি করতে চাই, যেখানে একাধিক নারী একত্রে কাজ করতে পারবে।
নিজের ব্যবসার পাশাপাশি ইতিমধ্যে এই নারী উদ্যোক্তা বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং দিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে গহনা তৈরির প্রশিক্ষণ, বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বিনির্মাণ প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।


তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে কান্তা চক্রবর্তী বলেন, আমার পরামর্শ হলো, স্বপ্ন দেখুন ও সেটাকে বিশ্বাস করুন। আর অবশ্যই কাজ শুরু করুন। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করবেন না। ব্যর্থ হলে ভেঙে না পড়ে তা থেকে শিখুন ও কখনো হাল ছাড়বেন না। টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখুন, এটা খুব জরুরি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করুন। নিজেকে নিজে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুললে আপনি অবশ্যই সফল হবেন।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button