বগুড়া জেলা
প্রধান খবর

‘দেশে বৈষম্য দূর হলেই বাবার আত্মা শান্তি পাবে’

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন: ‘বাবা বিএ পাশ করেও চাকরি পাননি। সেই আক্ষেপ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান বাবা। কিন্তু এখনও সেই বৈষম্য দূর হয়নি। দেশে বৈষম্য দূর হলেই আমার বাবাসহ সকল শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।’


কথাগুলো বলছিলেন জুলাই আন্দোলনে বগুড়া শহরের বড়গোলায় প্রাণ হারানো রিকশাচালক আব্দুল মান্নানের ছেলে রায়হান সরকার (২৪)। গত বছরের ৪ আগস্ট আব্দুল মান্নান (৬৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তিনি বগুড়া সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের বানদিঘী পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।


রায়হান সরকার জানান, তার বাবা বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। কিন্তু কোনো চাকরি না পাওয়ায় রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। এ জন্য বাবার মনে আক্ষেপ ছিল। যখন বৈষম্য নিয়ে আন্দোলনে দেশ উত্তাল, তখন বাবাও এসব নিয়ে কথা বলতেন। ওই দিন (৪ আগস্ট) বাবা শহরের বড়গোলা এলাকায় গিয়ে গুলিতে শহীদ হন।


রায়হান বলেন, আমার বাবা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এখনও সেই বৈষম্য দূর হয়নি। দেশে বৈষম্য দূর হলেই আমার বাবাসহ সকল শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।


বানদিঘী এলাকায় মৃত আব্দুল মান্নানের বাড়িতে জানা যায়, তার পরিবারে স্ত্রী আছমা বেওয়া ও চার ছেলে। বড় ছেলে রানা হামিদ বিয়ের পর আলাদা সংসার করছেন। আর্থিক টানাপোড়নের সংসারে আব্দুল মান্নান নিজে বাড়ি করতে পারেননি।


ফুটো হওয়া টিনের চালের জরাজীর্ন মাটির বাড়িতে তিন ছেলে নিয়ে আছমা ভাড়ায় বসবাস করছেন। দুই ছেলে রায়হান ও রহিত কাঠমিস্ত্রির কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন। ছোট ছেলে মিনহাজ স্কুলে পড়ছে।
রহিত (১৮) জানান, ৪ আগস্ট আমরা সবাই শহরের দিকে গিয়েছিলাম। বাবা বড়গোলায় ছিল, সেখানে আমার সাথে একবার দেখাও হয়েছিল। পরে আমি অন্যদিকে চলে যাই। ১২ টার পর আমরা শুনি বড়গোলায় গোলাগুলি হয়েছিল। তখনই আমার মনে কেমন জানি করল। পরে শুনি বাবা গুলিতে মারা গেছে।


এই রিকশাচালকের পরিবার জানায়, আব্দুল মান্নানের মরদেহ তারা পেয়েছিলেন ৫ আগস্ট। আর শহীদ হওয়ার ৩ মাস ২১ দিন আদালতের নির্দেশে কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করা হয়। মারা যাওয়ার পর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে পরিবারকে। জেলা প্রশাসন থেকে তারা পেয়েছেন ২ লাখ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন থেকে সোয়া দুই লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে।


আব্দুল মান্নানের স্ত্রী আছমা বেওয়া বলেন, সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া তার ন্যায্য বিচার যেন হয়। সবাই তো আন্দোলনে গিয়েছিল। কিন্তু আমার স্বামী বিনা অন্যায়ে গুলি লেগে শহীদ হয়েছে। তার ন্যায্য বিচার আমরা চাই।


রিকশাচালক আব্দুল মান্নান এলাকায় সবার প্রিয় ছিলেন। আন্দোলনে যাওয়া আগেও অনেকের সাথে দেখা হয় তার। জানিয়েছিলেন আন্দোলনের যৌক্তিকতা।


সেলিনা বেওয়া নামে প্রতিবেশি বৃদ্ধা জানান, রিকশা গ্যারেজ করে মান্নান ভাইয়ের শহরে যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা হয়েছিল। আমাকে দেখে বলছিল হয় দেশ স্বাধীন হবে নয় তো শহীদ হবো। আমি বললাম, ওমন কথা বলে না মান্নান ভাই। আল্লাহ তোমাকে বেঁচে রাখুক। হায়াত দিক।
রিকশাচালক আব্দুল মান্নান শহীদ হওয়ার ঘটনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে মামলা করেন তার বড় ছেলে রানা হামিদ। মামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ৪ আগস্ট বেলা একটার দিকে বগুড়া শহরের প্রধান সড়কে বড়গোলা ট্রাফিক মোড় এলাকায় আন্দোলন চলাকালে রিভলবার, পিস্তল, বন্দুক, আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল ও দেশি অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলাও করা হয়। যুবলীগ নেতা আবদুল মতিন সরকার হাতে থাকা পিস্তলের গুলি রিকশাচালক আবদুল মান্নানের হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হয়। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ছাত্র-জনতা হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা চলে যান। পরে স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ আবদুল মান্নানকে উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button