গাবতলী উপজেলা

বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় কবিরাজি চিকিৎসায় হাত হারালেন লতা

অজপাড়া গাঁয়ের গৃহবধূ লতা। ঘাস কাটতে গিয়ে পা পিছলে গর্তে পড়ে হাতে ব্যথা পান। চিকিৎসা নিতে তরিঘরি করে চলে যান পাশের গ্রামের কবিরাজ আব্দুল হকের নিকট। কবিরাজ মশাই লাতাকে দেখে বলে দিলেন হাতের হাড় ভেঙেছে। রোগী এবং রোগীর সঙ্গে আসা আত্মীয়দের বলে দিলেন দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

কবিরাজের কথায় সায় দিয়ে লতা এবং তার সঙ্গের লোকজন কবিরাজকে চিকিৎসা শুরু করতে বলেন। এর মধ্যে চিকিৎসা বাবদ কত খরচ হবে তাও নির্ধারণ হয়ে যায়। কথা মতো কবিরাজ চিকিৎসা শুরু করেন। বিভিন্ন গাছের লতা পাতা স্কচ টেপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেন। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভাঙাস্থানে পঁচন ধরে যায়।

এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরতরা তাকে ভর্তি না করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। সেই সঙ্গে শহরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানোর কথাও বলে দেয়। তারপর সেই ক্লিনিকে ভর্তি হয় লতা। সেখানে ডাক্তার লতার হাতের তিনটি জায়গা কেটে ফেলে। অপারেশন শেষে লতাকে আবার মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। লতা এখন মেডিকেলের বেডে শুয়ে শুয়ে হাতহারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের সোনাকানিয়া গ্রামে। লতা বেগম (৩৮) ওই গ্রামের হানিফের স্ত্রী।

লতা জানান, ঘটনার দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে মাঠে ঘাস কাটতে গিয়ে পা পিছলে গর্তে পড়ে যান। এ সময় তার বাম হাত ভেঙে যায়। সেখানে উপস্থিত লোকজন তাকে উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী নশিপুর ইউনিয়নের নিজগ্রাম এর কবিরাজ আব্দুল হকের কাছে নিয়ে যায়। কবিরাজ তার চিকিৎসা করেন। কলাপাতা, বিভিন্ন গাছগাছরার ওষুধ এবং বাটি, টেপ দিয়ে তার হাতে পেঁচিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। কবিরাজের ব্যান্ডেজ করার পর থেকেই তার হাতে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়। পরদিন কবিরাজ আব্দুল হক তার বাড়িতে গিয়ে ব্যান্ডেজ খুলে লবণসহ হালকা গরম পানি দিয়ে তার হাত ধুয়ে দিয়ে আবারও গাছগাছরার ওষুধ, কলাপাতা আর বাটি টেপ দিয়ে তার হাতে আটকে দেন। এরপর তার হাতে জ্বালা যন্ত্রণার পরিমাণ বেড়ে যায়। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি তার হাত থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হতে থাকে এবং ব্যাথার মাত্রাও বাড়তে থাকে। এরপর তাকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে নেয়া হয়।

গৃহবধূর চাচা-শ্বশুর মোখলেছুর রহমান জানান, তার অবস্থা বেগতিক দেখে বগুড়া মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসি। নার্সরা তার ব্যান্ডেজ খুললে দেখা যায় তার হাতের মাংসগুলো খুলে পড়ছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল সেখান থেকে। তারপর তাকে ভর্তি না করে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছে। ডাক্তার বললেন, হাত কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। পরে লতাকে শহরের সিটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হলে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল তার হাত অপারেশন করেন। এতে তার বাম হাত পুরোটাই কেটে ফেলতে হয়েছে।

এবিষয়ে কবিরাজ আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বললে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তার ভুল চিকিৎসায় লতার ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল আলম জুয়েল ঢাকাটাইমসকে বলেন, কবিরাজ লতার হাত শক্ত করে বেঁধেছিল। ফলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে ভাঙাস্থানে দ্রুত পঁচন সৃষ্টি হয়। লতার হাত কাটা ছাড়া উপায় ছিল না।

অপারেশনটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন করা হলো না জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘটনার দিন ছিল বৃহস্পতিবার। ফলে হাসপাতালে জনবল কম ছিল। তাকে ওই দিন অপারেশন না করলে বাঁচানো যেত না ফলে সিটি ক্লিনিকে নেয়া হয়েছিল।

প্রত্যেক গ্রামে কবিরাজদের দালাল আছে

এদিকে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এখনো কবিরাজদের দৌরাত্ম লাগামহীনভাবে চলছে। তাদের খপ্পরে পড়ে শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে শতশত মানুষ। এর পরেও থামছে না কবিরাজদের অপচিকিৎসা সচেতন হচ্ছে না সাধারণ মানুষও। এসব কবিরাজের নিয়োগ করা দালাল প্রত্যেক গ্রামেই আছে। গ্রামের কোনো মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা এগিয়ে এসে কবিরাজদের দরবারে হাজির করার এসব রোগীদের। এতে একটা মোটা অংকের কমিশন পেয়ে থাকে তারা।

পেটের ব্যথা, ভেঙে যাওয়া, মচকে যাওয়া, মাথা ঘোরাসহ ছোটখাটো রোগের জন্য ঝাড়ফুঁতেই নির্ভরশীল চরের মানুষ। এসব কবিরাজরা বিভিন্ন গাছের লতাপাতা শেকড় দিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন। যেকোনো রোগের চিকিৎসা করে থাকেন এসব কবিরাজ। এমনকি ক্যানসার, ডায়াবেটিক, জন্ডিসের মতো মারাত্মক রোগও তারা গাছের তৈরি ঔষধ দিয়ে থাকেন।

চরের সহজ সরল মানুষগুলো এসব কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়ে প্রতিনিয়তই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। কবিরাজদের ঔষধে রোগ বালাই না সারলেও তাদেরকেই বিশ্বাস করতে হয় চরের মানুষদের।

এছাড়াও প্যারালাইসি রোগীকে ঝাড়ুপেটা করা হয়। প্রকাশ্যে রোগীকে ঝাড়ু দিয়ে গোটা শরীর পেটাতে থাকে। মাঝে মধ্যে কিছু মন্ত্র পাঠ করে রোগীর শরীরে জোরে ফুঁ-দিয়ে দেয়। এভাবে চিকিৎসা করে অকালে অনেকেই মারাও যায়। তবুও থেমে নেই সনাতনি এসব চিকিৎসা।

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার ছাইদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, চরের মানুষের মধ্যে এখনো কু-সংস্কার বিদ্যমান আছে। কবিরাজদের পাশাপাশি চরে কিছু পল্লি চিকিৎসক আছে যারা কিচিৎসার কিছুই না বুঝলেও চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তাদের অপকিচিৎসার ফলে রোগী দ্রুত আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।  চরের এসব মানুষকে চিকিৎসা সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তুলতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস)

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button