বগুড়ার ইতিহাস

বগুড়া জেলার পরিচিতি

জেলা পরিচিতিঃ বগুড়া উত্তরবঙ্গের একটি শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর। এটি রাজশাহী বিভাগ এর অন্তর্গত। বগুড়াকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার  বলা হয়; মূলতঃ ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায় বগুড়া হয়ে যেতে হয় বলে এমনটি বলা হয়। জেলা-শহর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫০ সালে। বগুড়া পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৮৪ সালে। রাজশাহী জেলার ৪টি থানা (আদমদীঘি, বগুড়া, শেরপুর ও নওখিল), দিনাজপুরের ৩টি থানা (লালবাজার, বদলগাছী ও ক্ষেতলাল) এবং রংপুরের ২টি থানাসহ (গোবিন্দগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ) মোট নয়টি থানা নিয়ে ১৮২১ সালে বগুড়া জেলা গঠিত হয়। পরবর্তীতে জেলার প্রাথমিক কাঠামো থেকে ৯টি থানা বাদ দিয়ে নুতন সাতটি থানা সংযোজন করে বৃহত্তর বগুড়া জেলা গঠন করা হয়। বগুড়া জেলাকে ১৯৮৩ সালে বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ভাগ করা হয়।  বগুড়া শহরের আয়তন ২৬.৮৬ বর্গকিলোমিটার, যা ২১ টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। বগুড়া শহরে “শহীদ চান্দু” নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে; এছাড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (সরকারি) শহর থেকে সামান্য দুরেই অবস্থিত। বগুড়া দইয়ের জন্য খুব বিখ্যাত। বগুড়া শহরে থেকে ১১ কিঃমিঃ উত্তরে মহাস্থানগড় অবস্থিত, যা একসময় প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল এবং সেসময় পুণ্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়াউর রহমান বগুড়ার জেলার গাবতলী উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন।

আয়তন (বর্গ কিমি)২,৯১৯
উপজেলা সংখ্যা১২
পৌরসভা সংখ্যা
ইউনিয়ান সংখ্যা১০৮
মৌজা সংখ্যা১৭৮২
গ্রাম সংখ্যা২৬৯৫

ভৌগলিক অবস্থানঃ বগুড়া শহর করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত । অবস্থান: ২৪°৩২´ থেকে ২৫°০৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫৮´ থেকে ৮৯°৪৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। করতোয়া নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বগুড়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে । বগুড়ার উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা পশ্চিমে নওগাঁ জেলা, দক্ষিনে সিরাজগঞ্জ জেলা এবং পুর্বে যমুনা নদী।

মানচিত্রঃ

জনসংখ্যাঃ

মোট জনসংখ্যা২৯,৮৮,৫৬৭
ঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি)১০৪০
শহর৩৮৯০৬৯
গ্রাম২৬২৩৯৮৭
পুরুষ১৫৪৭৩৪১
মহিলা১৪৬৫৭১৫
মুসলিম২৮১৯৪৩২
হিন্দু১৯১৫২৮
বৌদ্ধ৬৬৬
খ্রিস্টান২৯৭
অন্যান্১১৩৩

জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান প্রধান উৎসঃ কৃষি ৫৭.৩২%, অকৃষি শ্রমিক ২.৩৯%, শিল্প ১.৭২%, ব্যবসা ১৩.৬৩%, পরিবহণ ও যোগাযোগ ৪.৬২%, চাকরি ৭.৬৬%, নির্মাণ ৪.৫৯%, ধর্মীয় সেবা ০.১৭%, রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স ০.৬৩% এবং অন্যান্য ৭.২৭%।

উপজেলা সমূহ:

উপজেলা নামআয়তন (বর্গ কিমি)জনসংখ্যা
কাহালু২৩৮.৭৯২,১৯,০০০
বগুড়া সদর১৭৬.৫৮৫,৫৫,০১৪
সারিয়াকান্দি৪৩২.৫৫২৪০০৮৩
শাজাহানপুর২১৫.৬৪২,৮৯,৮০৪
দুপচাঁচিয়া১৬২.৪৫১,৭৬,৬৭৮
আদমদীঘি১৬৮.৮৪১,৮৭,০১২
নন্দীগ্রাম২৬৬১,৬৮,১৫৫
সোনাতোলা১৫৬.৭৬১,৬৭,৫৪৭
ধুনট২৪৭.৭৫২,৬৬,০০১
গাবতলী১৩৯.৬০২,৯০,১৯০
শেরপুর২৯৬.২৭২,৮২,৮৮৭
শিবগঞ্জ৩১৫৪,২৭,৯১৩

নির্বাচনী এলাকা:

  1. বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা)
  2. বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ)
  3. বগুড়া-৩ (দুপচাঁচিয়া-আদমদীঘি)
  4. বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম)
  5. বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট)
  6. বগুড়া-৬ (বগুড়া সদর)
  7. বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর)

শিক্ষাব্যবস্থা:

শিক্ষার হার (%)৪১.৯
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় হার (%)৪২.৯
পুরুষ (%)৪৮
মহিলা (%)৩৭.৫

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (১৯৯২), সরকারি আজিজুল হক কলেজ (১৯৩৯), বগুড়া জেলা স্কুল (১৮৫৩), বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৬৯), কাহালু উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৭৩), সোনাতলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯০৮), আদমদীঘি উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৮), গোসাইবাড়ী এএ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৮), তালোড়া আলতাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৮), দুপচাঁচিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৩), শিবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩১), দুপচাঁচিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৪৪), নওখিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০১), দেবডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০৩), ছাগলধরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০৪), সারিয়াকান্দি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০৫), হাটফুলবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০৫), কাজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯০৫), সোন্দাবাড়ি দারুল হাদীস রহমানীয়া মাদ্রাসা (১৭০০), সরকারি মোস্তাফাবীয়া আলীয়া মাদ্রাসা (১৯২৫)। কলেজ : ৪৪, মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ২৯৯, মাদ্রাসা : ৩২৯।

কৃষিঃ ধান, পাট, গম, আলু, মরিচ, সরিষা।

অর্থনীতিসাম্প্রতিক বছর গুলোতে বগুড়া শহরের অবকাঠামোগত প্রচুর উন্নতি সাধিত হয়েছে । নতুন শহর পরিকল্পনার মাধ্যমে রাস্তাগুলো পুননির্মান এবং দু লেনে উন্নিতকরণ করা হয়েছে । এখানকার মাটি বেশ উর্বর এবং এখানে প্রচুর শস্যের উৎপাদন হয় । বিগত কয়েক বছরে বগুড়ায় লাল মরিচের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা কিনা ১০০ কোটি টাকার ব্যাবসায় পরিণত হয়েছে । ব্যাবসা- বাণিজ্যের উন্নতির সাথে সাথে এখানকার ব্যাংকিং ব্যাবস্থাপনাতেও এসেছে নতুন মাত্রা । সরকারি বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকের একটি করে শাখা রয়েছে এখানে । ২৪ ঘন্টাই শহরের যে কোনো প্রান্তে এটিএম বুথ খোলা পাওয়া যায় । ২০০৮ সালে ফ্রান্সের একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ড্যানোন গ্রুপ গ্রামীণ গ্রুপের সাথে যৌথভাবে শক্তিদই তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ।

যোগাযোগ ব্যাবস্থাঃ ট্রেন, বাস উভয় পথেই রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ রয়েছে, এছাড়া শহরের অদূরে কাহালুতে রয়েছে একটি বিমানবন্দর।বগুড়াকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয়। মূলত ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ জেলায় যেতে বগুড়াকে অতিক্রম করতে হয় বলেই এরকম বলা হয়ে থাকে।বগুড়ার যোগাযোগ ব্যাবস্থা খুবই উন্নত মানের। ট্রেন এবং বাস উভয় ব্যবস্থায় ঢাকা থেকে আসা যায়। জেলায় মোট রাস্তার পরিমাণ ৬,০৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা রয়েছে ২,৩১০ কিলোমিটার এবং কাচা রাস্তা রয়েছে ৩,৭৩১ কিলোমিটার। এছাড়াও জেলার উপর দিয়ে ৯০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে.

ঢাকা পঞ্চগড় হাইওয়েটি বগুড়া জেলার একেবারে মধ্যভাগ দিয়ে শেরপুর, শাহজাহানপুর, বগুড়া সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলা দিয়ে চলে গেছে। ভারী এবং দূর পাল্লার যানবাহন চলাচলের জন্য মূল সড়কের পাশাপাশি রয়েছে প্রশস্ত দুটি বাইপাস সড়ক। প্রথমটি পুরাতন বাইপাস নামে পরিচিত শহরের পশ্চিম দিকে মাটিডালি থেকে শুরু হয়ে বারপুর, চারমাথা, ১ নং রেলগেট, ফুলতলা হয়ে বনানীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। দ্বিতীয়টি নতুন বাইপাস নামে পরিচিত যা ২০০০ সালের পরবর্তীকালে নির্মিত হয়। দ্বিতীয় বাইপাসটি মাটিডালি থেকে শুরু হয়ে শহরের পূর্ব পাশদিয়ে জয়বাংলা বাজার, সাবগ্রাম হয়ে বনানীতে গিয়ে মুল সড়কের সাথে মিলিত হয়েছে। এছাড়া নাটোর, পাবনা, রাজশাহী সহ দক্ষিণ বঙ্গের জেলা গুলোর সাথে যোগাযোগের জন্য একটি আলাদা মহাসড়ক রয়েছে যা নন্দীগ্রাম উপজেলার মধ্যদিয়ে নাটোরের সাথে সংযুক্ত। নওগা জেলার সাথে যোগাযোগের জন্য চারমাথা থেকে আরেকটি সংযোগ সড়ক কাহালু, দুপচাঁচিয়া, সান্তাহারের মধ্য দিয়ে নওগাঁয় গিয়ে শেষ হয়েছে। এছাড়া বগুড়া জয়পুরহাট জেলাকে সংযুক্ত করার জন্য রয়েছে আলাদা সড়ক ব্যবস্থা।

বগুড়া জেলার সর্ব পশ্চিমে রয়েছে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন। বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্রডগেজ লাইন নাটোর থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত সান্তাহাররের উপর দিয়ে চলে গেছে। এছাড়া সান্তাহার থেকে একটি মিটারগেজ লাইন আদমদিঘী, তালোড়া, কাহালু, বগুড়া শহরের মধ্যদিয়ে রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটকে সংযুক্ত করেছে।

বগুড়ার একমাত্র বিমানবন্দরটি[৪] কাহালু উপজেলার এরুলিয়া নামক স্থানে অবস্থিত। তবে বিমান বন্দরটি সাধারণ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।

পর্যটনঃ পর্যটনের জন্য রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবে বিখ্যাত “মহাস্থানগড়” যা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সবার কাছেই পবিত্র একটি স্থান । এছাড়াও আছে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর, গোকুল মেঢ়, ভাসু বিহার, যোগীর ভবণ,‍‍‌ বিহার, ভিমের জঙ্গল, খেরুয়া মসজিদ, শেরপুর । বগুড়া শহরে রয়েছে “নওয়াব প্যালেস” যা ব্রিটিশ আমলে “নীলকুঠী” নামে পরিচিত ছিল । এখানে থাকার জন্য রয়েছে চার তারকা বিশিষ্ট হোটেল “নাজ গার্ডেন” ।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থানঃ খেরুয়া মসজিদ (শেরপুর), মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ, বড় মসজিদ, শাহ সুলতান বলখীর মাযার, পাঁচপীর মাযার, গোকুল মেধ, পরশুরামের প্রাসাদ, বসু বিহার, পল্লী-উন্নয়ন একাডেমী, সাউদিয়া পার্কসিটি, ভিমের জাঙ্গাল, নবাব বাড়ি প্যালেস মিউজিয়াম, কারুপল্লী, ওয়ান্ডারল্যান্ড শিশুপার্ক, শাহনেওয়াজ শিশুবাগান, উডবার্ন পার্ক, দৃষ্টিনন্দন পার্ক, বিজয়াঙ্গন (মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যাদুঘর)।

পত্র-পত্রিকা : বাংলাদেশ, করতোয়া, সাতমাথা, দূর্জয় বাংলা, আজ ও আগামীকাল, চাঁদনীবাজার, উত্তরকোণ, বগুড়া, উত্তরাঞ্চল, মুক্তবার্তা, উত্তরবার্তা; সাপ্তাহিক: আজকের শেরপুর, পঞ্চনদীর তীরে, নতুন, দূর্জয়, সাহিত্য, তারুণ্য; অবলুপ্ত: সোনাতলা বার্তা; অনিয়মিত সাময়িকী: বৃত্ত।

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বপ্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮) – ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের নেতা; মোহাম্মদ আলী বগুড়া (মৃত্যুঃ ১৯৬৯) – কূটনীতিক এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী; খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম (১৯৩৫-১৯৭৬) – মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং বিমান বাহিনীর সবেক প্রধান; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) – সাহিত্যিক ও গল্পকার; গাজীউল হক (১৯২৯-২০০৯) – ভাষা সৈনিক; এম. আর. আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪) – লেখক এবং সাংবাদিক; মুশফিকুর রহিম – বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট টেস্ট দলের অধিনায়ক; রোমেনা আফাজ – সাহিত্যিক। শফিউল ইসলাম সুহাস- একজন বাংলাদেশী ক্রিকেটার । ডঃ এনামুল হক ( একুশে পদক ২০১৪, স্বাধীনতা পদক ২০১৭)।

সংস্কৃতিঃ জারিগান, মারফতি, ভাটিয়ালি, কবি গান, কীর্তন, যাত্রাপালা, মেয়েলি গীত, প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধাঁ উল্লেখযোগ্য।

নদী-নালা ও খাল-বিল: করতোয়া, যমুনা, নাগর, বাঙ্গালী।

নামকরণ ইতিহাসঃ উত্তরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত পুণ্ড্রনগর খ্যাত বগুড়ার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানিক নাম ছিল ‘বগ্ড়ী’। সেটা রাজা বল্লাল সেনের আমল। সেই আমলে বঙ্গদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গ, বরেন্দ্র, মিথিলা, বাঢ় ও বগ্ড়ী। শেষোক্ত ‘বগ্ড়ী’ অংশে নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ‘বাগিদ’দের সংখ্যাগুরুত্ব ও অধিক শক্তিমত্তা ছিল। এই বাগদি শব্দটিই অপভ্রংশ ‘বগ্ড়ী’ রূপ ধারণ করতে পারে। কালে রূপান্তরিত এই ‘বগ্ড়ী’ই ‘বগুড়া’ উচ্চারণে স্থির হয়েছে বলে একটি ধারণা রয়েছে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ বগুড়ার অবস্থান বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে নয়। অপরদিকে প্রচলিত আছে যে ১২৮১-১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লরি সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের ২য় পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দীন বগরা খান বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁর নামানুসারে বগুড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিঃ স্বাধীন বাংলাদেশে শুয়ে আছে রক্তের উপরে। শুধুমাত্র সামান্য ক’টি মানুষের রক্ত নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত নদীর ধারার উপরে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উৎসর্গ পাত্রটি হৃদয়ে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো এতো রক্তের নির্গমন দেখেনি। মানবিক ও লৌকিক বাস্তবতার এতো ত্যাগ খুব কম দেশই স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দিতে পেরেছে। বাংলাদেশতাই হয়ে উঠেছে মুক্তিকামী মানুষের এক বিস্ময়কর রক্তরঞ্জিত প্রত্নশক্তি। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল এই শাশ্বত সৃষ্টি, এই অমর কীর্তি। অর্জিত সে কীর্তির উপর আজ বসবাস করছে পনেরো কোটি স্বাধীন বাঙালি। সর্বসুবিধা ভোগ করছে একটি স্বাধীন দেশের। নেতানেত্রী বনে যাওয়ার, মন্ত্রী, আমলা, ডাক্তার, ব্যবসায়ী প্রকৌশলী বনে যাওয়ার অফুরন্ত সুযোগ ভোগ করছে।একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে কাজ করার সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। একাত্তরের বাঙালি রুখে দাঁড়াতে না পারলে, এতো ত্যাগ বিসর্জন না হলে, বাঙালিদের চিরকাল পাকিস্তানি উপনিবেশিক শেকলে বন্দী থেকে ভৃত্যের মতো বসবাস করতে হতো। মুক্তিযুদ্ধের এই ত্যাগকে আজ যারা হেয় প্রচার করছে, তারাই এই রাষ্ট্রের সর্বসুবিধা ভোগের আয়াসে চেটেপুটে খাচ্ছে।পাকিস্তানিদের পদলেহনকারী এই নির্লজ্জ দালালরা লক্ষ লক্ষ বাঙালির আত্মোৎসর্গকে হাজার মানুষের হত্যাকান্ড হিসেবে কটুক্তি করে থাকে। স্বাধীনতাকে খাটো করে দেখার এই প্রবৃত্তি জন্ম নেয় একধরনের হীনমন্যতা বোধ থেকে। পাকিস্স্তানিদের দালালি করার অবৈধ ও অশ্লীল সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হওয়ার অপমান বোধ থেকে তারা এই নেতিবাচক প্রচার প্রচারণা চালাতে তৃপ্তি বোধ করে। মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘিষ্ট এই তাহজীব তমুদ্দুনজীবী গোষ্ঠী এ ধরনের নিন্দাবাদের স্রষ্টা ও প্রচারক। যুদ্ধাপরাধ সেসময় এরাই ঘটিয়েছিল। বুদ্ধিজীবি হত্যা, ধর্মের নামে নারকীয় অত্যাচার উৎপীড়ন, খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষন প্রভৃতি নারকীয় দুঃশাসনিক কর্মকান্ড এদের মাধ্যমেই বিকাশ ঘটেছিল উপনিবেশিক শাসকের নির্দেশে বা ছায়ায়। এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়টিকেএতকাল পরে এদেশের মানুষকে বিভক্ত করার কৌশল হিসেবে প্রচার করে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে এদের মস্তিষ্ক প্রসূত উদ্ভাবনা যে শুধু বিকৃত চিন্তার ফসল তা কিন্তু নয়। এটা হচ্ছে অপরাধকে আড়াল করার এক ধরনের অপকৌশল। কেননা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নিজেদের কৃতকর্ম তাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এদেশের মানুষের এই নবজাগরণ তাদের এতটাই ভীত করে তুলেছে যে,পূর্বকৃত্যের ভুলের মাশুল গোপন করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। সমাজ ও ইতিহাস সচেতন মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে বিভ্রান্ত করে তোলার জন্য তারা একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি চেতনার এক সুষমা মন্ডিত আভা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির এক অসাধারণ প্রেরণার উৎসমুখ। যে প্রেরণায় এক মহত্তম দুঃসাহসের বাস্তবায়ন আমরা ঘটাতে পেরেছি। সত্তরের নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার অশুভ পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলেই এর সূচনা হয়। সারাদেশে পাকিস্তান বিরোধী তীব্র আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠে। ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। বগুড়াও সেই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি প্রতিটি মহল্লায় কমিটি তৈরী করে অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা করে। প্রতিদিন মিছিল ও জনসভা চলতে থাকে। ছাত্রজনতার মিছিলে শ্লোগানে উচ্চারিত হতে থাকে। তেসরা মার্চের অধিবেশন হতে হবে, নইলে বাংলা স্বাধীন হবে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। সে সময় সারা দেশের মতো বগুড়াও ছিল ছাত্রজনতার মিছিলের শহর। বগুড়া জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে বিশাল জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এমন বস্ত্তনিষ্ঠপ্ররোচনা দানকারী, সময়োপযোগী ও স্পর্শকাতর ভাষণ গোটা বিশ্বে প্রায় নজিরবিহীন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বগুড়ার রাজনৈতিক আন্দোলনে এতে নতুন শক্তি ও মাত্রা যুক্ত হয়। বগুড়ার আপামর জনসাধারণ সেই প্রথম এক দুর্নিবার শক্তি অর্জন করে। স্বাধীনতা একমাত্র স্বাধীনতাই হয়ে ওঠে বাঙালির জন্য তাৎপর্যবহ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের এই পলিমাটিতে স্বাধীনতার এক অলৌকিক চেতনার বীজ বুনে দিয়ে যায়। মার্চ মাসব্যাপী এই আন্দোলন চলতে থাকে সমানতালে। একাত্তর এনে দিয়েছিল তরুণ ও নবীন প্রজন্মের কাছে এক বাধানা মানার আগ্নেয় উত্তাপ। ২৫ মার্চ আসে সেই কালরাত্রি। পাকিস্তানি বাহিনী পৈশাচিক শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর। চলে ক্র্যাক ডাউন। জার্মানীতে হিটলারী হলোকস্টও যার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।

এ দুঃসংবাদে প্রমত্ত হয়ে ওঠে বগুড়া। চারিদিকে নানা গুজব ও আশঙ্কা। সামরিক আইনের জাতাকল ভেঙ্গে ফেলার পণ। এসময় সংবাদ পাওয়া যায় যে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান আর্মি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী সহ বগুড়ার দিকে মার্চ করছে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সদর রাস্তা ব্যারিকেডে ভরে ওঠে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত কর্মপ্রয়াসে। যে যেভাবে পারে আর্মস সংগ্রহ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি আর্মি বগুড়ায় প্রবেশকালে মাটিডালিতে ব্যারিকেড দেওয়া অবস্থায় এক রিক্সাচালককে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধে তিনিই প্রথম শহীদ হন। তিনিই প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। সড়কপথে কালিতলা হাটে পাকিস্তানি আর্মি শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আধুনিকভাবে সুসজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির সাথে কমব্যাট যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্যহন। পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে বড়গোলায় মুক্তিযোদ্ধা আজাদ শহীদ হন। রেলগেটে মালট্রেনের বগি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানি আর্মি বেশ শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়।রেললাইনের আশেপাশে কতিপয় দরিদ্র দোকানদারকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মি রেলগেট পার হতে না পেরে সেখানেই থমকে যায়। ছাত্রনেতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এই মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল ও বন্দুক সহ পাকিস্তানি আর্মির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়। সকাল ৪টা থেকে প্রায় ১১টা পর্যমত্ম এই ভয়ঙ্কর লড়াই চলে। পাকিস্তান আর্মি আর কোন সুবিধা করতে না পেরে রেলগেট এর ঘুমটি ও বড়গোলা থেকে পিছু হটতে থাকে। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে সেদিন যে অসীম সাহস, ধৈর্য্য ও মনোবল দেখিয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। পাকসেনারা মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি আর্মিরা যখন এভাবে রিট্রিট করছিল, তখন বড়গোলার মোড়ে তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অসীম সাহসে চ্যালেঞ্জ করে। পাক আর্মি নিচ থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে পাক আর্মির হাতে তারা স্যারেন্ডার করতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা সেখানে নির্মমভাবে মোস্তাফিজার রহমান চুন্নু ও টিটুকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে। হিটলুকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। শোনা যায় হিটলুকে তারা মেরে ফেলে তার লাশ লুকিয়ে ফেলে। বগুড়ার প্রথম পর্যায়ের এই মুক্তিযুদ্ধ ও সড়কপথে জনতার লড়াই আজো আমাদের স্মৃতি বিস্মৃতিতে এক মহান ত্যাগের মহিমা হয়ে আছে। আজো চোখ মুদলে দেখি জেগে ওঠে অজস্র দৃশ্য। যেন অন্তহীন এক চলচ্চিত্র তার সবাক দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়। আমরা যারা কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ চোখের সামনে অবিরাম ঝলমল করে ওঠা দৃশ্যের পর দৃশ্য। এ দৃশ্য বেদনার ও বিষন্নতার। এ দৃশ্য যুগপৎ আনন্দ ও সুখের। এ দৃশ্য ত্যাগ ও অর্জনের। ত্যাগ ও অর্জন বিশাল। আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ যার নাম। যে বাংলাদেশে আজো মুক্তিযুদ্ধের নামে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। যে বাংলাদেশকে ‘‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো, তবু এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী এই ঘোষণা আজো আমাদের রক্তে প্রচন্ড আলোড়ন জাগায়। শিহরণ তোলে। আবেগ সৃষ্টি করে। যে উদ্দীপনায় আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। আর বাংলাদেশের রক্তাক্ত ভূমিতে সমস্ত চক্রান্ত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।

২৫ শে মার্চে কালো রাত্রিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার জন্য রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্ত্তত হয়ে আছে। বগুড়া থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানতে পারেন যে, একদল পাকিস্তানি সৈন্য রংপুর থেকে রওনা হয়েছে। রাতের মধ্যে শেষ করে দিবে বগুড়ার সমস্ত মানুষকে। হত্যাযজ্ঞের নীল নকসা তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় একসাথে অপারেশন চালানো হবে।এ খবর পাওয়া মাত্র দ্রুত জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা প্রচার করলেন-‘‘জাগো জাগো বগুড়াবাসি। রংপুর থেকে আর্মি রওনা দিয়েছে। রাস্তায় ব্যারিকেড লাগাও প্রতিরোধ কর। জাগো জাগো’’। বগুড়া শহরের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় জীপ নিয়ে প্রচার করলেন ওসি সাহেব। এর মধ্যে মমতাজ উদ্দিন, হায়দার আলী, এ কে মজিবর রহমান, মোশারফ হোসেন মন্ডল, লাল ভাই, তপন, স্বপন, ডাঃ জাহিদুর রহমানের সাথে দেখা করলেন ওসি সাহেব। খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। আশ্বাস দিল আপনারা প্রতিরোধ করুন, পুলিশও থাকবে।সমস্ত শহরে রাতের অন্ধকার চিরে শ্লোগান ভেসে উঠলবীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।সাইরেন বেজে উঠল কালিতলা মসজিদ থেকে রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে নিমিশের মধ্যে সমস্ত বগুড়া শহর মিছিলে মিছিলে আর শ্লোগানে কেঁপে উঠল। সবাই মিলে রংপুর রোডে গাছ ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের আর্মিরা ধীরে ধীরে দানবের মত এগিয়ে আসছে বগুড়া শহরের দিকে। পাকিস্তানি আর্মিদের জীপগুলো এসে থামলো, দেখলো রাস্তা বড় বড় গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। পাকিস্তানের সৈন্যরা ব্যারিকেড সরালো এবং মোকামতলার দিকে রওনা হলো। ঠেঙ্গামারার দিকে এসে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ির লড়ি থামল। পাকিস্তানি মেজর ইশারা দেয়ার সাথে সবাই দ্রুত পজিশন নিল। তারপর বলল ফায়ার। প্রথমে বুকে গুলি খেয়ে পাখির মত গাছ থেকে ঢলে পড়ল ঠেঙ্গামারার রিকসা চালক তোতা। এই তোতাই বগুড়ার প্রথম শহীদ।

নসরতপুর রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধঃ সময়টা ১৯৭১ এর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ কিংবা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে। আদমদীঘি উপজেলাধীন নসরতপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাহাড়ারত পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকারদের পাকড়াও করার জন্য একরাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনসুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মোজাম্মেল হক, মোখলেছার রহমান ও আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রায় দেড়-দু’শ মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা পর্যদস্ত হয়ে রেল লাইন বেয়ে পশ্চিম দিকে সান্তাহারে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে হলুদঘর গ্রামের এন্তাজ নামের একজন রাজাকার চোখে গুলির আঘাত লেগে মারাত্মক আহত হয় এবং রাজাকার আবুল (বেলপাড়া), বছির (থলপাড়া), আজিজার (শাকোয়া), ফজলু (ধামাইল) ও আবের (হলুদঘর) অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।

আদমদীঘি রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধঃ সময়টা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি আদমদীঘি রেলওয়ে স্টেশনে থাকা পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকারদের ওপর বীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আমজাদ হোসেন ও আবুল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধা দলপ্রবল আক্রমণ চালায়। দীর্ঘক্ষণ যাবত গুলি বিনিময় হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। অতঃপর পাকিস্স্তানি সৈন্যরা ক্রোলিং করে রেললাইন বেয়ে পশ্চিম দিকে সান্তাহারে পালিয়ে যায়। রাজাকার লুৎফর রহমান (তালসন), ছালাম (তালসন) সহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো ৪/৫ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।

কুসম্বীর যুদ্ধঃ এ যুদ্ধটি হয় ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার দিন। সকালে আদমদীঘি থানা সদর পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প হতে (প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানি সৈনিক দক্ষিণে রাণীনগর থানাধীন ভান্ডার গ্রাম যায়।খবরটি জনৈক সংবাদদাতা আদমদীঘির পাশে রামপুরায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিলেটারি আমজাদ হোসেন ও এল,কে, আবুলকে দেয়। খবর চেয়ে উভয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাঁদের সঙ্গীয় সহযোদ্ধাদের নিয়ে কুসম্বী গ্রামে এসে রাস্তা সংলগ্ন ঝোপ ঝাড় বেষ্টিত এক উঁচু পুকুর পাড়ে এ্যাম্বুশ করে থাকে ভান্ডার গ্রাম যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যাম্বুশের সামনে সদর রাস্তাটি ভাঙ্গা এবং কর্দমাক্ত ছিল। এই পথেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ফিরে আসবে। অনেক প্রতীক্ষার পর প্রায় ত্রিশ জন পাক আর্মি ফিরে এসে রাস্তার ভাঙ্গা যায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে পিছনের দলের আসার প্রতীক্ষায়। একটু পরপর আরো দু’দল পাকিস্তানি সৈন্য এসে উক্ত স্থানে একত্রিত হয়। ওদের সংখ্যা তখন ১০০ জন।এই ১০০ জনই মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ এ্যাম্বুশের মাঝে পড়ে। সঙ্কেত পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথম ফায়ারেই অধিকাংশ পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যায়। বেঁচে থাকা সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। এ অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় চলতে থাকলে রেলযোগে তালোড়া এবং সান্তাহার হতে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য এসে আদমদীঘি রেল ষ্টেশনে নেমে আক্রান্তদের ডিফেন্স দেয়ার জন্য এগুতে থাকে। ওরা মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে করতে কুসম্বীর দিকে এগিয়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধা দল এ্যাম্বুশ প্রত্যাহার করে পালিয়ে যায়।তালসনের সোনাতন গাড়োয়ানের গরুর গাড়িতে করে মৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ আদমদীঘি রেলওয়ে ষ্টেশনে নিয়ে আসে। পরে সোনাতন গাড়োয়ানের কাছ থেকে জানা যায়, ওই দিন কুসম্বারযুদ্ধে ৯৬ টি লাশই সোনাতন গাড়োয়ান গরু গাড়িতে করে আদমদীঘি রেলওয়ে ষ্টেশনে বয়ে এনেছিল।

আদমদীঘি থানায় যুদ্ধঃ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে আদমদীঘি থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকারদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বীরমুক্তিযোদ্ধা মেলেটারি আমজাদ হোসেন, আবুল হোসেন এবং এলকে আবুলের মুক্তিযোদ্ধা দল। উদ্দেশ্য ছিল হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমি আদমদীঘি থানা সদর শত্রুমুক্ত করা।মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমনের কাছে টিকতে না পেরে আর্মিরা সান্তাহারের দিকে পালিয়ে যায় এবং ৪/৫ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এদিন হতে আদমদীঘি থানা সদর শত্রুমুক্ত হয়।

ডালম্বা-পাইক পাড়া যুদ্ধঃ এ যুদ্ধটি হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর। বিভিন্ন স্থানে তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়ক বেয়ে সান্তাহার-নওগাঁর দিকে পায়ে হেঁটে পালাচ্ছিল। পলায়নপর একদল পাক সেনার ওপর এদিন বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের ডালম্বা-পাইকপাড়া নামক স্থানে বীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আমজাদ হোসেন এবং মিলেটারি আব্দুল হাকিম (বড় আখিরা) এর সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ডহরপুর গ্রামের মৃত নীলচাঁদ প্রামানিকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সাত্তার শহীদ হন। তাঁর এফএফ নং ৪৪৩৯। কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যরা সান্তাহারের দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

শহীদ সুজিত গেটে দুর্ঘটনাঃ এটা ছিল ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। এটা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ নয়। একটি সমাপ্তি দুর্ঘটনা মাত্র। শহীদ সুজিত বর্মণ ছিলেন ময়মনসিংহের ছেলে। তিনি সান্তাহারের বীরমুক্তিযোদ্ধা এলকে আবুলের গ্রুপে যুদ্ধরত ছিলেন শ্যামলা বর্ণের ছিপছিপে সুজিতের মুখমন্ডল ছিল গোলাকার। স্বাস্থ্য ছিল ক্ষীণ। ১৯৭১ সালে তিনি বি,এস,সি ক্লাশে পড়তেন।এই মুক্তিযোদ্ধার এইটুকু তথ্যই জানা গেছে। তিনি ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা রোড রেল ক্রসিংও বলা হয়। সেখানে শহীদ সুজিত রেললাইনের ওপর একই সাথে ৮টি এন্ট্রি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে ট্রেন আসার সাথে সাথে ব্লাস্ট করার প্রতীক্ষায় থাকেন। কিন্তু সংযোগ প্রদানে ভুল থাকার কারণে কিংবা তারে কোনো লিকেজ থাকার কারণে অথবা অন্য কোনো ত্রুটির জন্য ট্রেন আসার আগেই মাইনগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে এবং সে মাইন বিস্ফোরণের আঘাতে সুজিত ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এই মুক্তিযোদ্ধার কোনো পিতৃপরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

সান্তাহারের যুদ্ধঃ তারিখটা ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এদিন সান্তাহার শহরকে মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক হতে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে করতে শহরের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। একদল মুক্তিযোদ্ধাবীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে টিয়র পাড়া ব্রিজ হয়ে কলোনীর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদল হালালিয়া ষ্টেশন হতে রেললাইন বেয়ে দক্ষিণ দিক হতে অগ্রসর হয়।তৃতীয় দলটি অগ্রসর হয় উত্তর পশ্চিম কোণ দিয়ে। ত্রিমুখী আক্রমনের তোড়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরূপায় হয়ে পশ্চিমে নওগাঁ শহরে পালিয়ে যায়। গুটিকতক বিহারি রাজাকার ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এবং গুলি করে তাদের হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা।এইদিন সান্তাহার শত্রুমুক্ত হয়। ফলে সমগ্র আদমদীঘি উপজেলাই শত্রুমুক্ত হয়। কথিত আছে হযরত আদম বাবা ইয়াসিনী বহু যুগ আগে এখানে আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি আদমদীঘি সদরে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তখন পানীয় জলের খুবই অভাব ছিল। হযরত আদম বাবার অনুরোধে রাণীভবানী হযরত আদম বাবার আস্তানার দু’পাশে মস্তবড় দু’টি দীঘি খনন করে দেন। এই দীঘি দু’টির নাম দেয়া হয় আদমদীঘি। সেই থেকে এ স্থানটির নামও হয়ে যায় আদমদীঘি।হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমিতে অত্যাচারী পাকিস্তানি সৈন্যরা দম্ভভরে টিকতে পারেনি। পৃথিবীর বিখ্যাত যুদ্ধবাজ সৈনিক হয়ে তাঁদের পরাস্ত হতে হয়েছে বাংলার দামাল সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমি আদমদীঘি শত্রুমুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৌর্য বীর্যের কারণে আদমদীঘিবাসী বুক ভরে নেয় মুক্ত নিঃশ্বাস। উপভোগ করেস্বাধীনতার স্বাদ। দু’দিন পর ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ন বিকেল ৪টা ২১ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইষ্টার্ন কমান্ড প্রধান আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে নিঃশর্তভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। সমগ্র বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত। মুক্তিযোদ্ধা তথা বাঙালি জাতি অর্জন করে বিজয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নঃ গণকবর ৫ (তালোড়া দুপচাঁচিয়া সড়কের পাশে পদ্মপুকুর নামক স্থান, শাজাহানপুরের বিবির পুকুর, নন্দীগ্রামের বামন গ্রাম, সোনাতলার হারিয়াকান্দি, ধুনট থানার পাশে); বধ্যভূমি ১ (শেরপুরের বাঘড়া কলোনী গ্রাম); স্মৃতিস্তম্ভ ৩ (কাহালু উচ্চ বিদ্যালয় স্মৃতিসৌধ, আদমদীঘির শ্মশানঘাট স্মৃতিস্তম্ভ, ধুনট শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ)।

জেলার পটভূমিঃ উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত বগুড়া সদর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বিশ্বরোড নামক প্রশসত্ম সড়ক। বাংলাদেশের একমাত্র ফাউন্ড্রি শিল্পখ্যাত বগুড়া সদর উপজেলা। ফাউন্ড্রি শিল্পের পাশাপাশি বর্জ্য তুলা, ঝুট কাপড়, সাবান, বেডসীট মশারী কাপড়, জুট মিলস, পেপার মিলস, ফিড মিলস, সিমেন্ট কারখানা, পোল্ট্রিশিল্প সহ এগ্রো বেসড্ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ সব শিল্প প্রতিষ্ঠান হতে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন হয়। যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, কানাডা সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তান্তি বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

এ উপজেলায় মহাসড়কের দু’পাশে অবস্থান করছে প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত বগুড়া সদর উপজেলার গ্রামগুলো। উপজেলাটি খাদ্য শস্য ও শাকসবজি উৎপাদনের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত। এ জনপদের জনসাধারণের বহুদিনের আশা-আকাংখার প্রতিক শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শহীদ চাঁন্দু আমত্মর্জাতিক ক্রিকেট ষ্টেডিয়াম, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিÿণ ও গবেষণা একাডেমী, এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ অন্যতম নারী সংগঠন পরবর্তীতে এনজিও হিসাবে পরিচিত ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ ( টিএমএসএস) এর সদর দপ্তর এ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত। এছাড়া, গোকুল ইউনিয়নে মেধ নামক স্থানে ঐতিহাসিক বেহুলা – লক্ষিনদরের বাসর ঘর, চাঁদমুহা হরিপুর-সাহার বিল এলাকায় চাঁদ সওদাগরের বসতবাড়ি, নামুজা ইউনিয়নের চিংগাসপুরে পদ্মাদেবীর বাড়ি, লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের রায়-মাঝিড়ায় কালু গাজীর কোর্ট এবং নুনগোলা ইউনিয়নের হাজরাদিঘী এবতেদায়ী মাদ্রাসা সংলগ্ন সাপের ওঝাঁ ধনমত্মরীর বাড়ি অবস্থিত। উপজেলার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় সার্কিট হাউজ সংলগ্ন নবাববাড়ি যা বর্তমানে প্যালেস মিউজিয়াম ও কারুপলস্নী নামে বহুল পরিচিত। ঐতিহাসিক আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ ও বগুড়ার উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি যা ১৮৫৪ সালে স্থাপিত হয়েছে। উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি সংলগ্ন স্থানে বৃটেনের রাজ পরিবারের সদস্য এ্যাডওয়ার্ড সপ্তম জজ এর একটি প্রাচীন ভাস্কর রয়েছে। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদৎ বরণকারি দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট ৭জন বীরশ্রেষ্ট সমত্মানের স্মৃতিসত্মম্ভ স্থাপনা উলেস্নখ্যযোগ্য। উত্তরবঙ্গে সর্বপ্রথম আমত্মর্জাতিক মানের চার তারাকা হোটেল নাজ গার্ডেন এবং শিশুদের চিত্তবিনোদনের স্থান ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক সদর উপজেলাতেই অবস্থিত। এ উপজেলায় তদানিমত্মন পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধূরী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক রোমেনা আফাজ, এম.আর আকতার মুকুল, বি.এম ইলিয়াস, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, পলস্নী কবি রোসত্মম আলী কর্ণপুরী, কণ্ঠশিল্পি আঞ্জুমান আরা জম্ম গ্রহণ করেছেন।

ঐতিহ্যবাহী উৎসব-পোড়াদহ মেলা: বগুড়ার ঐতিয্যবাহী মেলার মধ্যে পোড়াদহ মেলা[৫] উল্লেখযোগ্য। বগুড়া শহর হতে ১১ কিলোমিটার পূর্বদিকে ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ নামক স্থানে সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর এ মেলা হয়ে আসছে। মেলার নাম পোড়াদহ মেলা। পোড়াদহ নামক স্থানে মেলা বসে তাই নাম হয়েছে পোড়াদহ মেলা। কথিত আছে প্রায় সাড়ে চারশত বছর পূর্বে থেকে সন্ন্যাসী পুজা উপলক্ষে এই মেলা হয়ে আসছে। পূজা পার্বন হিন্দুদের উৎসব হলেও এই মেলা ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠছে পূর্ব বগুড়ার সকল ধর্মের মানুষের মিলন মেলায়। প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ দিনের কাছের বুধবারে এই মেলা হয়ে আসছে। মেলার প্রধান আকর্ষন বড় মাছ আর বড় মিষ্টি। এছাড়াও থাকে নারীদের প্রসাধন, ছোটদের খেলনা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র। কাঠ ও স্টিলের আসবাব পত্রও সুলভ মুল্যে পাওয়া যাবে এ মেলায়। এছাড়াও আছে নাগড়দোলা, সার্কাস, মটরসাইকেল খেলার মত মজার সব ব্যবস্থা। মেলা উপলক্ষে দুর দুরন্ত হতে আত্বীয়রা এসে ভরে যায় প্রতিটি বাড়ি। মেয়েরা জামাই সহ বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে। ঈদ, দূর্গা পুজার মত বড় উৎসবের পাশাপাশি এই মেলা পরিনত হয়েছে মানুষের মিলন মেলায়। মেলা প্রধানত একদিনের হলেও উৎসব চলে তিনদিন ব্যাপি। বুধবার মুল মেলার পরদিন বৃহস্পতিবার একই স্থানে এবং একই সাথে আশেপাশের গ্রামে গ্রামে চলে বউ মেলা। যেহেতু অনেক মেয়েরা মুল মেলায় ভিরের কারণে যেতে পারেনা তাই তাদের জন্যই এই বিশেষ আয়োজন। বউ মেলায় শুধু মেয়েরা প্রবেশ করতে পারে এবং কেনাকাটা করতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ   আদমশুমারি রিপোর্ট ২০১১, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; বগুড়া জেলা সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০০৭।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button