শহীদ বুদ্ধিজীবী মহসীন আলী দেওয়ান
মুক্তিযুদ্ধ বগুড়া: আজ ৩রা জুন। ৭১ এর এ দিনে বগুড়ার কৃতি সন্তান মহসীন আলী দেওয়ান সাহেবকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয়। এর পর আর তাঁকে পাওয়া যায় নি।
মহসীন আলী দেওয়ান ছিলেন বিরল প্রতিভাধর এবং বহুমুখি গুনের অধিকারী। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছাত্রদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে পাঠ্য পুস্তক প্রকাশ করেজুগের চাহিদা পুরনে এগিয়ে আসেন। তিনি অমায়িক, বিনয়ী ও মধুর স্বভাবের জন্য সর্বজনপ্রিয় ব্যাক্তি হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ছাত্রদের জন্য তিনি বহু সংখ্যক পাঠ্য বই রচনা করেন। তিনি প্রগতিশীল সংস্কৃতিক আন্দলনের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন।
১৯৩৯ ১লা জানুয়ারী তৎকালীন বগুড়া জেলার জয়পুরহাটের ধলাহার ইউনিয়নের ভুটিয়াপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন মহসীন আলী দেওয়ান। পিতার নাম – মঙ্গল আলী দেওয়ান ও মাতার নাম – ছলেমন নেছা। সহধর্মিণীর নাম – দেওয়ান ফজিলাতুন্নেসা রেবা। তিনি নওগাঁ জেলার নজিপুর হাইস্কুল (পত্নিতলা উপজেলা) থেকে সম্ভবত ১৯৫০ সালে মেট্রিক পাশ করেন।
এরপর বগুড়া আযিযুল হক কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে পর্যায়ক্রমে আই.এ. এবং স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
ছাত্র জীবনে ছিলেন একজন জনপ্রিয় ছাত্র নেতা। বগুড়া আযিযুল হক কলেজের “ছাত্র সংসদ” নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর শিক্ষকতার কাজে আত্ন নিয়োগ করেন। কর্ম জীবনে নওগাঁ কলেজে বংলার প্রভাষক হিসাবে কাজ করেন।
পরে বগুড়া আযিযুল হক কলেজের অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের প্রধান রুপে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
পড়ে উক্ত পদে ইস্তফা দিয়ে শেরপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন।
জয়পুরহাট কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন।
বগুড়া আইন কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
বগুড়া শাহ সুলতান কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তা ও উক্ত কলেজের নাম করন তিনিই করেন।
তিনি ছিলেন বগুড়া জেলার খ্যাতনামা সাংবাদিক।
তিনি এম.এ. পাশ করার পূর্বে ছাত্র জীবনে ১৯৫৪ সালের “দৈনিক ইত্তেহাদ” এর স্টাফ রিপোর্টার ও সহযোগী সম্পাদক ছিলেন।
১৯৬১ সালে ৩০শে অক্টোবর তিনি “বগুড়া বুলেটিন” নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি মহসিন আলী দেওয়ান ও আমানুল্লাহ খান যৌথ ভাবে সম্পাদনা করতেন। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হলেও ইংরেজি নামের কারনে যা নিয়ে একবার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। পত্রিকাটি “আর্ট এন্ড পাবলিসিটি” নামক প্রতিষ্ঠান থেকে মহসিন আলী দেওয়ান কর্তৃক প্রকাশিত এবং “সাধনা প্রেস” বগুড়া থেকে মুদ্রিত হতো। পরবর্তী কালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
পরে “উত্তরবঙ্গ বুলেটিন” নামে একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মহসিন আলী দেওয়ান নিজেই এই পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। এই পত্রিকার সহকারি সম্পাদক ছিলেন তবিবর রহমান। বগুড়ার তৎকালীন “দেওয়ান প্রিন্টিং প্রেস” থেকে মুদ্রিত এবং “বুলেটিন হাউজ” থেকে প্রকাশিত হতো। তৎসময়ে “বগুড়া বুলেটিন” সমগ্র উত্তরবঙ্গে সমাদৃত হয়েছিল। তা বগুড়ার সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি অবিস্মরণীয় নাম।
১৯৬০ সালে “অতএব” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি “লিথগ্রাফিক প্রিন্টিং ওয়ার্ক্স লিমিটেড” থেকে মুদ্রিত হতো এবং “আর্ট এন্ড পাবলিসিটি” থেকে প্রকাশিত হতো। পরবর্তীতে “অতএব” পত্রিকা সিনেমা সংক্রান্ত সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশ হওয়ায় তা বগুড়ার প্রথম সিনেমা পত্রিকা হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। সর্বশেষে পত্রিকাটি “সাধনা প্রেস” বগুড়া থেকে মুদ্রিত হতো।
মহসিন আলী দেওয়ান বগুড়ার সংবাদ পত্রের ইতিহাসে আর একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহন করেন। তিনি বগুড়া থেকে বগুড়ার ইতিহাসে প্রথম একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। উক্ত দৈনিকটি সান্ধ্য দৈনিক হিসাবে “জনমত” নামে প্রকাশিত হতো। তৎসময়ে সমগ্র উত্তরবঙ্গের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশ করা ছিল সর্বপ্রথম এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। পত্রিকাটি আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারনে বন্ধ হয়ে যায়। জানা যায় পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে প্রকাশিত একটি বিশেষ সংখ্যার মুদ্রাকর ও প্রকাশকের নাম মুদ্রিত না হওয়ায় কর্তৃপক্ষপত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। তৎসময়ে বগুড়া সাংবাদিকগন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বা গঠনমূলক কোন ভূমিকা গ্রহন করতে পারেন নি।
বগুড়া জেলা পরিষদের মুখপত্র পাক্ষিক “মহাস্তান” ১৯৬৯-৭০ সালে মাসিক আকারে প্রকাশিত হয়, তখন উক্ত পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মহসিন আলী দেওয়ান।
তিনি বগুড়া প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি বগুড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
নিজ বাড়িতে “দেওয়ান বুক সেন্টার” নামে একটি প্রকাশনালয় এবং “আর্ট এন্ড পাবলিসিটি” নামে প্রেস স্থাপন করেন।
১৯৬৬ স্লে তিনি অত্যান্ত সাফল্যের সাথে বগুড়া জেলা কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতিও নির্বাচিত হন।
বগুড়া জেলা পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও বগুড়া জেলা প্রেস মালিক সমিতির সভাপতি হিসাবে জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
জাতীয় প্রতিষ্ঠান “বাংলা একাডেমি”র সদস্য ছিলেন।
তিনি ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে বগুড়া জেলায় অন্যতম সক্রিয় কর্মী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৮ সালে মে মাসে সরকারি সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমন করেন।
গল্প লেখক হিসাবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর “গল্পের চিড়িয়াখানা” নামে ছোটগল্পের সংকলন একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
মহসীন আলী দেওয়ান ছিলেন একজন রুচিশীল ও সংস্কৃতবান ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজ হাতে বাগান করতেন, হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করতেন। তাঁর বাড়ীতে পরিচিতজনের অবাধ যাতায়াত ছিল। উপাদেয় খাবার খেতে ও খাওয়াতে পছন্দ করতেন। নাচ-গান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পছন্দ করতেন। পল্লি গ্রামে বেড়ানো, কীর্ত্তন জ্ঞান এবং পল্লি জ্ঞান ছিল তাঁর বিশেষ ভালো লাগার দিক।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বগুড়া দখল করলে তিনি তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় গ্রামের লোকদের সাথে দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন। দখল করার পর সেনাবাহিনী স্কুল-কলেজ খোলার নির্দেশ দেয়। তিনি কলেজে যাননি। কিছুদিন পর থেকে কলেজের উপাধ্যক্ষ তাঁকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন তাঁর কাছে অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে। তিনি প্রথমে এই চাপ উপেক্ষা করেন। পরে ভয়ভীতি প্রদর্শন শুরু হলে তিনি ৩রা জুন দুজন ছাত্র ও কোরআনের একজন হাফেজকে সঙ্গে নিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে যান। উপাধ্যক্ষ দায়িত্ব বুঝে নিয়ে তাঁকে ভাঁওতা দিয়ে বগুড়া শহরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করেন। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ। কোথাও তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মহসীন আলীর মেয়ে স্নিগ্ধা মহসীনা আহসানের লেখায় এ ঘটনার বিবরণ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘…কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল বাবাকে কলেজের দায়িত্ব তাঁর হাতে বুঝিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অনবরত লোক পাঠাতে লাগল। বাবা যদি না যান, তবে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ভয় দেখাল। এভাবে চাপ সৃষ্টি করে জোর করে কলেজে নিয়ে গেল। আমার নানার গ্রাম থেকে তাঁর কলেজের দুজন ছাত্র ও একজন হাফেজ (কোরআন) সাহেবকে নিয়ে কলেজে গিয়েছিলেন। চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে যখন ফিরতে চেয়েছেন, তখন ভাইস প্রিন্সিপাল জোর করে বগুড়ায় বাবার প্রিয় বাড়ি দেখাবার লোভ দেখিয়ে এনে নরঘাতকদের হাতে তুলে দেয়। বাবার সঙ্গে সেই নির্দোষ হাফেজ সাহেবও নিখোঁজ হলেন।
আকবর আহমেদ এর ফেসবুক থেকে সংগৃহিত।
তথ্যসূত্রঃ আখতার উদ্দিন মানিক, সেলিনা শিউলী, মামুন রশীদ, জে.এম. রউফ।
কৃতজ্ঞতাঃ আলীম ভাই, নোবেল ভাই, গোলাম পাইকার ভাই, আরশাদ স্যার, আতাউর স্যার।