সোনাতলার নামকরণ ও ইতিহাস
বর্তমানে সোনাতলা নামে যে জায়গাটি খ্যাত পূর্বে তা ‘বালুআটা’ নামে পরিচিত ছিল। সে সময়‘বালুআটা’ ঝোপঝাড় ও বড় বড় জাঙ্গালে পূর্ণ ছিল। বর্তমান উপজেলা পরিষদ থেকে দুই -আড়্ইা কিলোমিটার পূর্বে বিশ্বনাথপুর গ্রাম সংলগ্ন বাঙ্গালী নদীর তীরে অবস্থান ছিল সোনাতলা নামের জনপদের। জনপদটি ব্যবসায়ীক বন্দর হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। ঐ স্থানে এসে দেশ – বিদেশের ব্যবসায়ীরা জমজমাট ব্যবসা করতো।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বালু আটায় রেল স্টেশন হওয়ায় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার্থে পুরনো সোনাতলার বাসিন্দারা নতুন ষ্টেশনের আশপাশে বসতি স্থাপন করে। তখন পুরনো সোনাতলার নাম অনুসারে নতুন বন্দরের নাম রাখা হয় সোনাতলা।
নতুন সোনাতলায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী গ্রামসমূহের অধিবাসীদের বসতি স্থাপন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে স্থানটি সরগরম হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে স্টেশন কেন্দ্রীক এই সোনাতলাই তার নিজের অবস্থান করে নেয় বাংলাদেশের মানচিত্রে। তৎকালীন দেওয়ানগঞ্জ থানার মধ্যে অস্তিত্ব ছিল আজকের সোনাতলার। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের এক পর্যায়ে সোনাতলা অঞ্চলটি অন্তর্ভূক্ত হয় বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার সঙ্গে। আরো পরে সোনাতলা এলাকাটি বগুড়ার গাবতলী থানাভুক্ত হয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে স্বতন্ত্র থানায় রুপ নেয় সোনাতলা এবং ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে পায় উপজেলার মর্যাদা।
নামকরণ সম্বন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তী
বর্তমান সোনাতলা প্রাচীনকাল থেকেই একটি প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীক বন্দর হিসেবে পরিচিত। এক সময়ের খরস্রোতা বাঙ্গালী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের জনবসতি। প্রাকৃতিক কারণে উর্বর এ অঞ্চলের ফসল বিশেষ করে, সোনালী আঁশ আকৃষ্ট করেছে ব্যবসায়ীদের। আর তাই বিভিন্ন সময় পালতোলা নৌকায় আগমন ঘটেছে বণিকদের। সোনাতলা নামের ইতিহাস নির্ভর কোন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। তবে সোনাতলা নাম সম্পর্কে প্রচলিত আছে বিভিন্ন কিংবদন্তী। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সোনাতলা নামের উৎপত্তি খুঁজতে বারবার ফিরে যেতে হয় কিংবদন্তীগুলোর কাছে।
কিংবদন্তীগুলো এ রকম
অনেকের মতে, এই অঞ্চলে প্রচুর পাট বা সোনালী আঁশ উৎপাদিত হতো। কিন্তু খরস্রোতা বাঙ্গালী নদী বিভিন্ন সময় দু’কূল প্লাবিত করে তলিয়ে দিত এই সোনালী আঁশ। এই পাট বা সোনালী আঁশ ঘন ঘন তলিয়ে যাওয়ার কারণে জায়গাটির নাম হয় সোনাতলা।
আবার কারো কারো মতে, জনৈক বণিক নৌকাযোগে প্রচুর সোনা, রুপা, ধন-রত্ন নিয়ে বাঙ্গালী নদী দিয়ে যাওয়ার সময় এই অঞ্চলে দৈব-দূর্বিপাকে তার নৌকাটি ডুবে যায়। সেই ধন-রত্ন বা সোনা-রুপা সমেত নৌকাটি তলিয়ে যাওয়ার কারণে লোকজন এ অঞ্চলের নাম দিয়েছে সোনাতলা।
অনেকের অভিমত, ‘‘এ অঞ্চলে বার ভূইয়াদের একজন ঈঁশা খা’র জমিদারী ছিল। ঈঁশা খা প্রায়ই নিজ পত্নী সোনা বিবিসহ বজ্রা নৌকা যোগে এখানে আসতেন। ঈশা খা’র পত্নী সোনা বিবির নামেই স্থানটির নাম হয়েছে সোনাতলা।”
কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, এ অঞ্চলে জনৈক হিন্দু ব্যবসায়ীর গোপী নামে ষোড়শী এক কন্যা ছিল। পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছিল বিনয়ী বিন্মর মুসলমান যুবক সোনাউল্লাহ্। বিনয়ী ও সদালাপী সোনাউল্লাহ্ এ লোকালয়ের সকলের কাছে সদালাপী ও প্রিয়পাত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। মুসলমান সোনাউল্লাহ্র সঙ্গে হিন্দু মেয়ে গোপী’র গড়ে ওঠে অসম প্রেম। এ প্রেমে বাধাঁ হয়ে দাঁড়ায় উভয়ের অভিভাবক মহল। প্রেম প্রণয়ে বাঁধার কারণে এক রাতে তারা মিলিত হয় তৎকালীন বাঙ্গালীর খরস্রোতা একটি শাখার তীরে। তারপর মনের ক্ষোভে উভয়ে ঝাপ দেয় খরস্রোতা সেই শাখায়। পরদিন সকালে উভয়ের জড়াজড়ি লাশ পাওয়া যায় সেই শাখার চরে। সোনাউল্লাহ্কে হারানোর বেদনায় লোকজন হতবাক হয়ে যায়। তাকে সম্মান দেখানোর জন্য তারা এ অঞ্চলের নাম রাখে সোনাতলা। আর গোপী’র নামে বাঙ্গালী নদীর খরস্রোতা শাখাটির নাম রাখে গোপাই বিল।
ইতিহাস
বগুড়া জেলার একটি প্রাচীন বন্দর সোনাতলা । অতি প্রাচীন কালে স্থানটি নদী গর্ভে দ্বীপ স্বরুপ তিনটি রাজ্যের সীমারেখায় ছিল বলে অনুমান করা হয়। রাজ্য গুলো হলো গৌড় রাজ্য, কামরুপ এবং পূর্ববঙ্গ। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থানটি ছিল প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, মূঘল আমলে বার ভূঁইয়াদের একজন ঈশা খা দিল্লীশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠান বিদ্রোহ দমনের জন্য। মানসিংহ বাংলায় এসে ছাউনী ফেলেন সোনাতলার গড়ফতেপুরে। সে সময় হতে সোনাতলা ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ।
সোনাতলার ইতিহাস বলতে যা কিছু পাওয়া যায় তার সবই প্রায় গড়ফতেপুর, মুন্ডুমালা, গড়চৈতন্যপুর প্রভৃতি গ্রামকে কেন্দ্র করে। তবে এ অঞ্চলকে ঘিরে রাখা গড়গুলো ছাড়া তেমন কোন স্থাপত্য নিদর্শন না পাওয়ায় এ ক্ষেত্রেও জনশ্র“তিকে গ্রহন করতে হচ্ছে ইতিহাসের উৎস হিসেবে। সোনাতলার গড়ফতেপুর গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে আধ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে আধ মাইল গড় দিয়ে বি¯তৃৃত ছিল। গড়ফতেপুরের পূর্ব দিকের গড়ের অতি সামান্য অংশ ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে এই গড়ের কিছু চিহৃ ছাড়া প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।পশ্চিম প্রান্তের গড়ের অর্ধেক কৃষি ক্ষেতে ও বিলে বিলীন এবং বাকী অংশের উপর বাজারের দোকানপাট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা পরিষদের অফিস আদালত ও দালান কোঠা গড়ে ওঠার ফলে গড়গুলির অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জনশ্র“তি আছে, উত্তর দিকের গড়টি ছিল সামরিক ঘাঁটির প্রধান রক্ষাপ্রাচীর এবং এ গড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছিল ‘চন্ডিদুয়ার’ নামে প্রধান ফটক। বর্তমানে চন্ডিদুয়ারে পানি জমে বিলের মতো হয়েছে। আয়তাকার এই বিরাট ‘পুর’ বা দূর্গের চারদিকে পরিখাতে সারা বছর যাতে পানি থাকতে পারে সেজন্য পূর্ব দিকের মাইল দেড়েক দূরের নদী থেকে খাল কেটে এনে পূর্বের পরিখার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এ হাতে কাটা খালের নাম ‘ভিমটি’। হাতে কাটা ‘ভিমটি’ খালের নামকরণ কৈবর্ত নায়ক ‘ভিমের’ নামে করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গড়ফতেপুরের গড়গুলোকে ঘিরে শক্তিশালী সামরিক কেন্দ্র ছিল। ‘ভিমটি খাল’ এবং ‘ভিমের জাঙ্গাল’ নামকরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, এই সামরিক কেন্দ্রও কৈবর্তদের তৈরী। পাল যুগে অল্পকালের জন্য কৈবর্ত নায়ক ‘দিব্যোক’, ‘রুদ্রক’ও ‘ভিম’ পালদের হাত থেকে বরেন্দ্রের (উত্তরবঙ্গ) শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেন। অবশ্য তারা শান্তিতে শাসন কার্য চালাতে পারেননি। পরাজিত ও নিহত পাল রাজা মহিপালের ভাই রামপাল তাদেরকে বরেন্দ্রে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন। এছাড়াও কৈবর্তরা পূর্ববঙ্গের বর্মন রাজবংশের বিরোধীতার সম্মুখিন হন। পাল রাজার সংগে ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বর্মনদের শত্র“তার ফলে কৈবর্ত নায়কেরা এত ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে, তারা বিশেষ স্থাপত্য নিদর্শন রেখে যেতে পারেননি। পক্ষান্তরে, গড়ফতেপুর যদি পালদের সামরিক অবস্থান হত তাহলে সেখানে অবশ্যই নির্মাতা হিসেবে অক্ষয় কীর্তির অধিকারী পাল রাজাদের স্থাপত্য নিদর্শনের সন্ধান মিলত।
বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে অসংখ্য কৈবর্তদের বসবাস ছিল। পালদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়া করে গড়বেষ্টিত সামরিক ঘাঁটি তৈরী করা তাদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আবার অল্পকাল পরে রামপাল বা তার মিত্রদের হাতে এর পতন ঘটাও স্বাভাবিক। কারণ রামপাল কৈবর্তদের গোটা অঞ্চল পুণরাধিকার করেছিলেন।
কৈবর্তদের পর গড়ফতেপুর পাল, সেন ও মুসলিম রাজ্যভুক্ত হয় । ইলিয়াছ শাহী বংশের পর হাবশী শাসনামলে (১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিঃ) কামতাপুরের খেন বংশীয় রাজারা এতদঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন। লোকমুখে শোনা যায় যে, কামরুপ রাজা নীলাম্বর এর বাড়ী ছিল বর্তমান নাজির আখতার কলেজের উচুঁ ভিটায়। খেন বংশের নীলাম্বর ছিলেন কামতা রাজ্যের রাজা। চতুর্দশ শতাব্দীতে কোচ বিহারকে রাজধানী করে কামতা রাজ্যের গোড়া পত্তন করেন দুর্লভ নারায়ণ। পুরো বৃহত্তর রংপুর ছিল এ রাজ্যের অধীনে। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে কামতা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নীলধ্বজ। নীলধ্বজের পুত্রের নাম চক্রধ্বজ এবং চক্রধ্বজের পুত্র নীলাম্বর। নীলাম্বরের সঙ্গে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নীলাম্বর রাজ্য হারান। মুসলিম বাহিনী গড়টি ফতেহ্ বা জয় করেছিল বলে গড়টির নাম রাখা হয় গড়ফতেপুর।
আবার এরুপ কাহিনীও প্রচলিত আছে, পীর ফতেহ্ আলী মতান্তরে ফতুল্লাহ্ কোন এক হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে গড়টি দখল করেছিলেন বলে তার নাম অনুসারে গড়ের নাম হয় গড়ফতেপুর। গড়ফতেপুরের উত্তর-পশ্চিমে প্রথম গড়ের বাইরে সমাহিত পীর ‘ফতেহ্ আলী’ বা ‘ফতুল্লাহ্’ সাধারণের কাছে ‘ঘোড়াপীর’ নামে অধিক পরিচিত। তিনি সব সময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন বলেই সর্বসাধারণ তাকে ঘোড়াপীর বলে ডাকত। সাধারণের বিশ্বাস ঘোড়াপীরই এই অঞ্চল জয়ী মুসলিম সেনাপতি।
গড়ফতেপুরের পূর্ব পার্শ্বের গ্রামের নাম মুন্ডুমালা। কিংবদন্তী আছে ,যে স্থানে গড়ের অধিপতির সঙ্গে আক্রমনকারীর সংঘর্ষে হাজার হাজার সৈন্যের মুন্ডু গড়াগড়ি গিয়েছিল সে স্থানের নাম মুন্ডুমালা। মুন্ডুমালার পাশেই ঠ্যাংগার বিল। লোকমুখে শোনা যায় যে, এখানেই ঠ্যাংগানোর কাজ অর্থাৎ যুদ্ধ হয়েছিল বলে স্থানটির নাম ঠ্যাংগার বিল। মুন্ডুমালা ও ঠ্যাংগার বিল নাম দুটি থেকে অন্তত এটুকু মনে হয় যে, গড়ফতেপুরের শাসনকর্তার সঙ্গে কোন আক্রমনকারীর তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। এই অঞ্চল থেকে ঈশা খাকে বিতাড়িত করে অঞ্চলটি মুঘল অধিকারে নেওয়ার জন্য সম্রাট আকবরের সেনাপতি শাহ্বাজখান প্রেরিত হন। তিনি যেখানে ছাউনী ফেলে যুদ্ধ করেছিলেন সে স্থানের নাম শাহ্বাজপুর।
১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে মেজর রেনেলকৃত মানচিত্রে একটি সামরিক রাস্তার অস্তিত্ব দেখা যায়। এ রাস্তাটি প্রাচীন রাজধানী গৌড় থেকে এসে জামালগঞ্জ, ক্ষেতলাল ও শিবগঞ্জ থানার মধ্য দিয়ে ফতেহপুর গড় ও দূর্গাহাটা গড়ের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল। অনুমান করা হয়, উল্লেখিত ফতেপুরই হচ্ছে বর্তমান সোনাতলার গড়ফতেপুর গ্রাম। বর্তমানে রাস্তাটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেলেও তা সোনাতলাকে ইতিহাসের সোনালী পাতায় স্থান করে দিয়েছে।
(লেখক সোনাতলার ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা, সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মি।)