বগুড়ার ইতিহাস

গৌর গোপাল চন্দ্রের জাদুর ছোঁয়ায় বগুড়ার বিখ্যাত দই

বগুড়ার দইয়ের খ্যাতির কথা উঠলেই গৌর গোপালের নাম আসে

বাঙালি জাতির একটি অদ্ভুত টাইটেল হলো, ‘ভোজন রসিক’। ভোজন প্রিয় এই জাতির খাবারে আছে বৈচিত্রময়তার এক অনন্য রূপ। স্থান কাল পাত্র ভেদে এসব খাবারের জনপ্রিয়তাও বেশ তুঙ্গে। কেউ কেউ এসবের স্বাদ পরখ করার জন্যে ছুটে চলে দেশের নানা প্রান্তে। এমনি এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের খোঁজে গিয়েছিলাম বগুড়া। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন- কীসের কথা বলতে যাচ্ছি। হ্যাঁ, বলছিলাম বগুড়ার দইয়ের কথা। উত্তরবঙ্গের এই প্রসিদ্ধ জেলায় এসেছি, আর দই না খেলে চলে! সারাদিন শহরের এমাথা-ওমাথা দৌড়ে যখন ভেঙে আসছে শরীরটা, তখনি খানিকটা দই আমায় জাগিয়ে তুলল। আসলে শুরুতে আমরা আসল-নকলের ভয় পাচ্ছিলাম। পরে স্থানীয় এক বন্ধুর সহযোগিতায় পেয়ে গেলাম আসল বগুড়ার দই। সে জানালো, ফুটপাত বাদে এখানকার সব দই-ই আসল। তবে দোকান ভেদে একটু স্বাদের তারতম্য আছে। ঊনিশ-বিশ বলা চলে।
সরার দই।

যাহোক, নাম করা এক দোকান থেকে কেজি খানেকের একটি মাটির সরা নিয়ে ঢুকে গেলাম পাশেই অবস্থিত মাঝারি মানের এক রেস্টুরেন্টে। অগন্তুক ভেবেই কিনা প্যাকেটটি দেখাতেই বয় এসে সুন্দর মতন পরিবেশন করে গেল। দইয়ের রঙটা মনে ধরাতে ঝটপট এক চামচ মুখে পুরতেই আমার জিভ সহ পুরো শরীর যেন আবেশে বুঁদ হয়ে রইল। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকেছি, মনে নেই। অথচ খাওয়ার আগে ধারণাই করতে পারিনি, এমন অমৃতের মতো এক অপার্থিব কিছুর স্বাদ নিতে যাচ্ছি। সত্যিই, মোলায়েম কাদার মতো দেখতে এই জিনিসটার এত স্বাদ এলো কোত্থেকে?

একটু ইতিহাস কপচানো যাক। বগুড়ার এই প্রসিদ্ধ খাবারের নাম কাগজে-কলমে আগে লেখা হতো ‘দৈ’। প্রায় ২০০ বছর আগে ঘোষ নামে পরিচিত পরিবারগুলো এই শিল্পের সূচনা করলেও আসলে এই দইকে সুখ্যাতি এনে দিয়েছে গৌর গোপাল ঘোষ। বগুড়ার দইয়ের খ্যাতির কথা উঠলেই গৌর গোপালের নাম আসে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গৌর গোপাল পরিবারসহ ভারত থেকে এদেশে চলে আসেন। আশ্রয় নেন বগুড়া মূল শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বর্তমানে শেরপুর উপজেলা সদরে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে। এসময় খুব দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করেন তিনি।

গরম দুধ সরাতে ঢালা হচ্ছে।

তবে দই বানানোর পদ্ধতি গোপালের আগে থেকেই জানা ছিল। শেরপুর থেকে দই বানিয়ে হেঁটে ভাড়ে করে আনতেন বগুড়া শহরের বনানী এলাকায়। দইয়ের সঙ্গে তিনি বানাতেন সরভাজা। ধীরে ধীরে তার এই সরভাজা এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, ঐ সময়ের জমিদারদের বাড়িতে সরভাজা সরবরাহের অর্ডার পেতে থাকেন গৌর গোপাল। জনসাধারণের মধ্যেও এ সরভাজা ব্যাপক সুনাম কুড়ায়। মূলত এ সরভাজাই গৌর গোপালকে এনে দেয় সুখ্যাতি। পরে একটা সময় সরভাজাই সরার দই হয়ে খ্যাতির তুঙ্গে ওঠে। যে দইয়ের সুনাম বগুড়াকে দেশ ছেড়ে বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছে।

এরপর গৌর গোপালের দিন ফিরে এলো। তার দইয়ের এ সুখ্যাতিতে বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর নওয়াব পরিবার তাকে ডেকে তাদের প্যালেসের আমবাগানে জায়গা করে দেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সেই আমবাগানে গৌর গোপাল স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। এরপর স্থানীয়দের অংশগ্রহনে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে শেরপুরেই গড়ে তোলা হয় দইয়ের কারখানা।

অল্প আঁচে দই জমানো হচ্ছে।

বগুড়ার দই বলতে আসলে শেরপুর উপজেলার দইকেই বোঝায়। যুদ্ধের পর বগুড়ায় দই তৈরিতে আলাদা মাত্রা যোগ করে দুটি মুসলিম পরিবার। বগুড়া শহরের মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলী। নব্বইয়ের দশকে এসে প্যাকেজিং ও দই সংরক্ষণে নতুনত্ব আনেন বগুড়ার ‘দইঘর’ এর মালিক আহসানুল কবির। ঐ সময় থেকে শহরের ভেতর সুসজ্জিত শো-রুম চালু করে দই বিক্রি শুরু হয়।

মূলত ষাটের দশকের শুরুতে বগুড়ার দইয়ের জনপ্রিয়তার গল্প ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। বৃটেনের রানী এলিজাবেথ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছে বগুড়ার দই। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বগুড়ায় এসে দইয়ের স্বাদ পেয়ে বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাদের সহানুভূতি পেতে পাঠান এই দই। একসময়কার প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী এ দইয়ের স্বাদ পেয়ে গৌর গোপালকে তাদের আমবাগানে স্থান দিয়ে তো রীতিমতো অবাক কান্ড ঘটিয়ে ফেললেন।
হাঁড়ির দই।

বগুড়ার দই বনেদী সুখ্যাতি পেয়েছে অনেক আগেই। এ অঞ্চলের বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও এই দই ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অতিথি আপ্যায়নে দই যোগ করাটা এ এলাকার ঐতিহ্যের অংশ। উপরন্ত সারা দেশে বগুড়ার পরিচিতি ধরে রেখেছে এই অনন্য স্বাদের দই। বিশেষ করে সরার দই। যদিও এখন মাটির নানা ধরনের পাত্রে এই দই বসানো হচ্ছে, তারপরও সরার দইয়ের বিশেষ কদর আছেই এবং থাকবে।

যাহোক, রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ঝোঁকের মাথায় কিনে নিলাম আরো দুই কেজি। স্থানীয় বন্ধুটি জানালো- গাড়ীতে উঠে যেন প্যাকেটটাকে নীচে না রাখি। ঝাঁকুনিতে নাকি দই উল্টেপাল্টে ঘেটে যায়। দোকানদার বলল, “এখন শীতকাল, সমস্যা হবে না।” তবুও বগুড়ার এই অসামান্য স্বাদের জিনিসে এতটাই বিভোর হয়েছিলাম যে, ফেরার সময় একবারের জন্যও প্যাকেটটা কোল ছাড়া করিনি। যদিও এটা ঐতিহ্যবাহী খাবার, তবু একে রেটিং দিতে বললে আমি ১০/১০ দিব।

শো-রুমে বিক্রির জন্য প্রস্ততকৃত দই।

দাম

বগুড়ার প্রসিদ্ধ এই দইয়ের দাম একদম হাতের নাগালে। নরমাল টাইমে এর দাম পড়বে প্রতি কেজিতে ২৫০-৩০০ টাকা। তবে বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের সময়ে, যেমন: ঈদ, পহেলা বৈশাখ, রোজা উপলক্ষে এর দামের তারতম্য ঘটে।

দোকানের অবস্থান

দেশের যেকোনো জায়গা থেকে বাস বা ট্রেনে করে বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার মোড়ে যাওয়া যায়। দোকানগুলো ঠিক সাতমাথার দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে। এখানে বিখ্যাত ‘মহরম আলী’, ‘আদি মহরম আলী’, ‘রফাত দইঘর’ ‘শেরপুর দইঘর’ ও ‘চিনিপাতা’ সহ বেশ কয়েকটি দোকান আছে। এছাড়া বিআরটিসি মার্কেটের ‘দইবাজার’, কাজী নজরুল ইসলাম সরণিতে ‘এশিয়া সুইটস’ ও ‘আকবরিয়া’ এর দইও খুব প্রসিদ্ধ। শেরপুর উপজেলা বাসট্যান্ডে অবস্থিত ‘সাউদিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ এর দইয়ের স্বাদও মনে রাখার মতো।

ঢাকার বাজারেও বগুড়ার দইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এখন খোদ রাজধানীতেও তা পাওয়া যাচ্ছে। বগুড়ার শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী সেই সুস্বাদু দই প্রতিদিন ঢাকায় নিয়ে আসছে ‘সামান্তা ফুড কোড’। রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় আছে সামান্তা ফুড কোডের নিজস্ব শো-রুম।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button