টিএমএসএসদুপচাঁচিয়া উপজেলা

দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন পা, বাঁচেনি সন্তান তবু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বগুড়ার অদম্য ‘সেতু’

টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা বেগম জানান, সেতু সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।

বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান ও সুলতানা রাজিয়ার মেয়ে মোস্তারী রহমান সেতু। বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ২০১২ সালে ডিপ্লোমা (পাওয়ার) করেছেন। একই বছর নাটোরের সিংড়া থানার সোহেল রানার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপর জীবিকার প্রয়োজনে দুজনই চাকরি নেন নারায়ণগঞ্জের সিনহা টেক্সটাইলে। এরই মধ্যে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন তিনি। আর গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়ই দুর্ঘটনার শিকার হন। দেশে চিকিৎসার পর মা, বাবা ও স্বামীর সিদ্ধান্তে তাকে ভারতে নেয়া হয়। সেখানে তিনি কৃত্রিম পা ব্যবহারের নানা দিক নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তবে টানা সাত মাস পর যখন দেশে ফেরেন, তখন তার মাথার ওপর ঋণের ভারী বোঝা।

২০১৫ সালের ২২ আগস্ট ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মোস্তারী রহমান সেতু যখন স্বামীর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলেন, তখন কল্পনাও করতে পারেননি, তার জন্য কী ভয়াবহ দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে। যানবাহনের অপেক্ষায় স্বামী সোহেল রানার সঙ্গে যখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, তখনই বালিবাহী একটি ট্রাক তাকে চাপা দেয়। ট্রাকের চাকা চলে যায় দুই পায়ের ওপর দিয়ে। জখম হন সোহেল রানাও। আহতাবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তির দুদিনের মাথায় সেতুর বাম পা কেটে ফেলা হয়। অকেজো হয়ে যায় ক্ষতিগ্রস্ত ডান পা। চিকিৎসারত অবস্থায়ই প্রায় দুই মাস পর অপারেশনে জন্ম দেন কন্যাসন্তানের। সন্তানটি ২৪ ঘণ্টার বেশি বাঁচেনি। এ মর্মান্তিক পরিণতিতে অনেকেই শেষ দেখে ফেলেছিলেন সেতুর জীবনের। তবে অদম্য মনোবলে ভর করে সেতু ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

এ অবস্থায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, সিনহা টেক্সটাইল, ইসলামী ব্যাংক, টিএমএসএস, বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ বহু স্থান থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু তাতে ঋণের বোঝা কমছিল না। ফলে ঘরে বসে না থেকে কীভাবে এ ঋণ পরিশোধ করা যায়, তার পরিকল্পনা করেন। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন তার স্বামী সোহেল রানা। বাড়ির কাছে ভাড়া নেন একটি দোকানঘর। সেখানেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টিএমএসএস (ঠেংগামারা মহিলা সবুজ সংস্থা) থেকে উজ্জীবিত প্রকল্পের আওতায় বিউটিশিয়ানের ট্রেনিং নিয়ে কাজ শুরু করেন সেতু। কিন্তু এ থেকে যে আয় হতো, তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ হচ্ছিল না।

এ অবস্থায় টিএমএসএস থেকে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ও বগুড়া জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা মিলে তাকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। উজ্জীবিত প্রকল্পের আওতায় পারিবারিক আয়বর্ধনে অনুদান হিসেবে পান দুটি ছাগল। পরে ইসলামী ব্যাংক বড়গোলা শাখা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে তাকে একটি ফটোকপি মেশিন কিনে দেয়। বর্তমানে সেতুর একটি মুদি দোকান রয়েছে। দোকানের নাম রেখেছেন মৃত সন্তানের স্মৃতিতে ‘সুরাইয়া স্টোর’।

টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা বেগম জানান, সেতু সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। একই কথা জানান ইসলামী ব্যাংক বগুড়া জোনাল অফিসের কর্মকর্তারাও। তারা সবাই মনে করছেন, জীবনযুদ্ধে সেতুর এ ঘুরে দাঁড়ানো এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

কথা হলে মোস্তারী রহমান সেতু জানান, স্বামীর কারণে বেঁচে আছেন। তিনি তাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা জুগিয়েছেন। মা-বাবা পাশে ছিলেন। দোকান ও ফটোকপি মেশিনের আয় দিয়ে গত এক বছরে কিছু ঋণ শোধ করেছেন। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ২ হাজার টাকা আয় করছেন। অবশিষ্ট ঋণও অচিরেই পরিশোধ করতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী তিনি।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিএকএসএফ) উপমহাব্যবস্থাপক ও উজ্জীবিত প্রকল্পের টিম লিডার ড. একেএম নূরুজ্জামান বলেন, উজ্জীবিত প্রকল্পের আওতায় ২৮টি জেলায় সেতুর মতো ছয় হাজারেরও বেশি প্রতিবন্ধীকে সহযোগিতা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সামাজিক ও আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন।

 

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button