বইবগুড়া সদর উপজেলা
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের সাথে কিছু সময়
স্যার, কত হলো বয়স?
স্যার বললেন, ৫০ শেষ করলাম, ৫১-তে পড়লাম।
জন্মসালটা কত?
ওইটা থাক
হ্যাঁ। তাহলে আজকে আপনার ৫০ বছর বয়স! ৫১ তম বর্ষে আপনি প্রবেশ করলছেন। ভালোই তো করলেন…বলে বুঝতে পারলাম, বোকার মতো বলে ফেলেছি, তখন আমার রেডিমেড হাসিটা বের করলাম।
একটা প্রশান্ত হাসিতে স্যারের মুখও ভরে উঠল।
স্যারের সঙ্গে ঠিক দেখা হয়েছিল ২ বছর আগে ।
আজ, শাওন সঘন বৃষ্টিমুখরিত ১৪ ফব্রুয়ারি ২০১৯-এর বিকেলে, প্রথম আলো অফিস গিয়ে হাজির হই। স্যারের অফিসে পৌঁছাতে হলে দুই ফুট বাই দুই ফুট লিফটে উঠতে হয়, সেটা আবার খানিকটা ঝাঁকুনি দেয়।
স্যারের বড় এই অফিসের বৈঠকখানাটা ছোট, কিন্তু তার আকাশটা বড়। একটা খোলা জানালার ওপারে আর কোনো ভবন নেই। এই বৃষ্টিকাতর সকালেও স্নিগ্ধ একরাশ আলো এসে পড়েছে ঘরে। স্যার জানালার দিকে মুখ করে বসেছেন। আমি আলোয় উদ্ভাসিত হাসিমাখা মুখখানিতে খানিকটা সতেজতাও দেখতে পাই। আমার ভালো লাগে।
মধ্যখানে বেশ কিছুটা সময় স্যারের স্বাস্থ্যটা খারাপ গেছে, তার মা ইহোকাল ত্যাগ করায় তার মনের অবস্থা খুব ১টা ভালো না । এখন নিজের মন কে বুঝিয়ে বেশ তরতাজা আছে মনে হয় ।
বললাম, স্যার, আশা তো আর দেখি না। আমার মনের মধ্যে মেঘ—
স্যার বললেন, শোনো, বেস কিছু দিন আগে শোপেনহাওয়ারের ওপরে পড়ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মনে হয়েছিল, মানুষের আর কোনো আশা নেই। কিন্তু মানুষ একটা আশ্চর্য ব্যাপার। সে ধ্বংস হতে চায় না, নিজেকে সে ধ্বংস করবে না। পুঁজিবাদ নিজেদের প্রয়োজনে প্রযুক্তি আনল, নিম্নমানের প্রযুক্তি, পরিবেশবিধ্বংসী। এখন পুঁজিবাদই তো নিজেদের প্রয়োজনে গ্রিন টেকনোলজি আনছে।
দেখো, এই যে প্রযুক্তি নারীদের মুক্ত করে দিল, তাদের আর ঘরে থাকতে হয় না—আগে কী ছিল, কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এখন বিজ্ঞান তাদের মুক্তি দিয়েছে। এটা মানুষের জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ। কারণ, নারীর মস্তিষ্ক অনেক ভারসাম্যপূর্ণ। পুরুষ তো শুধু ব্রেনের একটা অংশ ব্যবহার করেছে, হয় যুদ্ধ, নয়তো ফুটবল, নয়তো ব্যবসা; কিন্তু নারীকে চিরটাকাল চারদিক সামলাতে হয়েছে, ফলে তাদের ব্রেন সব দিকে বিকশিত হয়েছে। সেই বিপুল বুদ্ধিবৈভব এখন কাজে লাগছে, কত বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে।
কিন্তু স্যার, ইতিহাসে খারাপ শাসকেরা আসে, স্টালিন বা গাদ্দাফি, তারা…স্যার বলেন, তারা তো ইতিহাসে থাকে না। কিন্তু তাদের খারাপ প্রভাবের দায় তো ইতিহাসকে বইতে হয়…স্যার বললেন, হয়, কিন্তু মানুষের প্রবণতা হলো আবার আলোর দিকে যাওয়া। সে পরাজয় মেনে নেয় না। ভেতর থেকেই প্রতিরোধ গড়ে…
স্যার এর এসব কথা যেনো মাথার উপর দিয়ে চলে গেল ।কিছু না বুঝে উঠতেই স্যার বলল আচ্ছা তুমি তো অনেক দূর থেকে এসেছো আজ আমি বই মেলায় যাবো । তুমি কি যাবে ! স্যার এর কথা না শেষ হতেই বলে ফেললাম আমি কেনো নয় অবশ্যই যাবো আমি । স্যার বলল চল তাহলে যাওয়া যাক ।তারপর একসাথে বের হয়ে একসাথে চলে গেলাম প্রানের মেলা ২১ শে বই মেলা ।
২১ শে বই মেলাই ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হয়ে গেলো স্যার (আনিসুল হক), প্লিজ একটা অটোগ্রাফ দিন।
আনিসুল হকঃ তোমার নাম বল।
স্যার, প্লিজ একটা ছবি তুলি।স্যার তোলো।
স্যার, প্লিজ একটা সেলফি।
স্যার, ঠিক আছে।
লেখক ও পাঠকের এই কথোপকথন এর আগে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম আনেক বছর আগে । এটি এক ধরনের বিরক্তি সেই বিরক্তি নয়, যা অভক্তি যোগায়, বরং এর মধ্যেও একধরনের ভালোবাসা-প্রেম রয়েছে। যে কারণে লেখক-পাঠক কারোরই বিরক্তি ধরে না। বিষয়টি এতো সহজ নয়। বড় ধৈর্যের ব্যাপার। যা আমার নেই। আর আমার থাকবে কেন, আমি তো লেখক নই। আনিসুল হকের রয়েছে- এজন্যই তিনি লেখক। আমার দেখা লেখকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ধৈর্যশীল।
তারপর চলে যায় মেলার ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে। যেখানে উপস্থিত থাকতে হবে কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক কে । নিজের লেখক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আনিসুল হক তার বক্তব্য শুরু করেন। বলেন মজার সব ঘটনা।একজন দর্শক হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে, ‘যখনই আমি নিজে কোনো গল্প লিখতে বসি, তখনই আমার মনে হয় যে সেটা অন্য কোনো লেখকের গল্পের সাথে মিলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কী করব?’ উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘পৃথিবীতে নতুন গল্প বা কাহিনি বলতে কিছু নেই, নতুন হচ্ছে গল্প বলার ভঙ্গি। মানে নিজের গল্প লেখার ধরনটাই আসল বলতে পারো।’ এছাড়াও লেখক কীভাবে তার লেখার মাধ্যমে কোনো দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন, সেই রহস্যটাও তিনি জানান উপস্থিত দর্শকদের।
সব মিলিয়ে পরিশেষে বলতে চায় মানুষের জন্য তাঁর ছিল একবুক ভালোবাসা । 🙂🙂