২৫ মার্চ কালরাত্রিতে প্রতিরোধের যুদ্ধে বগুড়া কেমন ছিলো
চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা প্রচার করলেন-‘‘জাগো জাগো বগুড়াবাসি
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি চেতনার এক সুষমা মন্ডিত আভা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির এক অসাধারণ প্রেরণার উৎসমুখ। যে প্রেরণায় এক মহত্তম দুঃসাহসের বাস্তবায়ন আমরা ঘটাতে পেরেছি। সত্তরের নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার অশুভ পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলেই এর সূচনা হয়। সারাদেশে পাকিস্তান বিরোধী তীব্র আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠে। ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। বগুড়াও সেই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি প্রতিটি মহল্লায় কমিটি তৈরী করে অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা করে। প্রতিদিন মিছিল ও জনসভা চলতে থাকে। ছাত্রজনতার মিছিলে শ্লোগানে উচ্চারিত হতে থাকে। তেসরা মার্চের অধিবেশন হতে হবে, নইলে বাংলা স্বাধীন হবে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। সে সময় সারা দেশের মতো বগুড়াও ছিল ছাত্রজনতার মিছিলের শহর। বগুড়া জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে বিশাল জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
এমন বস্ত্তনিষ্ঠপ্ররোচনা দানকারী, সময়োপযোগী ও স্পর্শকাতর ভাষণ গোটা বিশ্বে প্রায় নজিরবিহীন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বগুড়ার রাজনৈতিক আন্দোলনে এতে নতুন শক্তি ও মাত্রা যুক্ত হয়।বগুড়ার আপামর জনসাধারণ সেই প্রথম এক দুর্নিবার শক্তি অর্জন করে। স্বাধীনতা একমাত্র স্বাধীনতাই হয়ে ওঠে বাঙালির জন্য তাৎপর্যবহ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের এই পলিমাটিতে স্বাধীনতার এক অলৌকিক চেতনার বীজ বুনে দিয়ে যায়। মার্চ মাসব্যাপী এই আন্দোলন চলতে থাকে সমানতালে। একাত্তর এনে দিয়েছিল তরুণ ও নবীন প্রজন্মের কাছে এক বাধানা মানার আগ্নেয় উত্তাপ। ২৫ মার্চ আসে সেই কালরাত্রি। পাকিস্তানি বাহিনী পৈশাচিক শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর। চলে ক্র্যাক ডাউন। জার্মানীতে হিটলারী হলোকস্টও যার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।
২৫ শে মার্চে কালো রাত্রিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার জন্য রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্ত্তত হয়ে আছে। বগুড়া থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানতে পারেন যে, একদল পাকিস্তানি সৈন্য রংপুর থেকে রওনা হয়েছে। রাতের মধ্যে শেষ করে দিবে বগুড়ার সমস্ত মানুষকে। হত্যাযজ্ঞের নীল নকসা তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় একসাথে অপারেশন চালানো হবে।এ খবর পাওয়া মাত্র দ্রুত জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা প্রচার করলেন-‘‘জাগো জাগো বগুড়াবাসি। রংপুর থেকে আর্মি রওনা দিয়েছে। রাস্তায় ব্যারিকেড লাগাও প্রতিরোধ কর। জাগো জাগো’’। বগুড়া শহরের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় জীপ নিয়ে প্রচার করলেন ওসি সাহেব। এর মধ্যে মমতাজ উদ্দিন, হায়দার আলী, এ কে মজিবর রহমান, মোশারফ হোসেন মন্ডল, লাল ভাই, তপন, স্বপন, ডাঃ জাহিদুর রহমানের সাথে দেখা করলেন ওসি সাহেব। খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। আশ্বাস দিল আপনারা প্রতিরোধ করুন, পুলিশও থাকবে।সমস্ত শহরে রাতের অন্ধকার চিরে শ্লোগান ভেসে উঠলবীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।সাইরেন বেজে উঠল কালিতলা মসজিদ থেকে রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে নিমিশের মধ্যে সমস্ত বগুড়া শহর মিছিলে মিছিলে আর শ্লোগানে কেঁপে উঠল। সবাই মিলে রংপুর রোডে গাছ ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের আর্মিরা ধীরে ধীরে দানবের মত এগিয়ে আসছে বগুড়া শহরের দিকে। পাকিস্তানি আর্মিদের জীপগুলো এসে থামলো, দেখলো রাস্তা বড় বড় গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। পাকিস্তানের সৈন্যরা ব্যারিকেড সরালো এবং মোকামতলার দিকে রওনা হলো। ঠেঙ্গামারার দিকে এসে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ির লড়ি থামল। পাকিস্তানি মেজর ইশারা দেয়ার সাথে সবাই দ্রুত পজিশন নিল। তারপর বলল ফায়ার। প্রথমে বুকে গুলি খেয়ে পাখির মত গাছ থেকে ঢলে পড়ল ঠেঙ্গামারার ট্রাক চালক তোতা। এই তোতাই বগুড়ার প্রথম শহীদ।
Source : http://journalisminstitutebd.com