বগুড়ার ইতিহাস

বগুড়া জেলার সুবিখ্যাত নবাব মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরীর জীবনী

মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরীর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ারের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতাঃ মরহুম মীর মসনদ আলী টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট জমিদার। মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরী পিতা-মাতার কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। তাহার পিতামহ মরহুম সৈয়দ মহব্বত আলী চৌধুরী টাঙ্গাইল আটিয়াতে এসে বিপুল সম্পত্তি ও জমিদারির মালিকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাহার পূর্ব পুরুষ সম্ম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ঢাকায় পীর বা আধ্যাতিক গুরু হিসেবে এদেশে আগমন করেন।
বগুড়ার নবাব মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরী ছিলেন আদর্শ জমিদার, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, দানবীর, সমাজ-হিতৈষী, বিদোৎসাহী ও মুসলিম বাংলার শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম দিশারি। সভা-সমিতি ও পত্র পত্রিকার সহিত জড়িত থেকে তিনি সমাজের হিত সাধন করেন। বাংলার মুসলিম রেনেসাঁয় তিনি অবদান রেখেছিলেন। মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরী এবং তাহার বড় ভাই সৈয়দ আব্দুল জব্বার চৌধুরী বগুড়ার বিখ্যাত নবাব পরিবারে বিবাহ করেন এবং বৈবাহিক সূত্রে তাহারা উভয়েই বিপুল বিত্ত বৈভবের অধিকারী হন। উভয় ভ্রাতা পৈতৃক নিবাস দেলদুয়ার ত্যাগ করে বগুড়া জেলায় বসতি স্থাপন করেন।
বগুড়ার নবাব মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরী বগুড়ার শেলবর্ষ পরগণার প্রসিদ্ধ জমিদার মরহুম সরওয়ার আলীর ভগ্নী মরহুমা তহরুন নেছার সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মরহুম সরওয়ার আলী নিঃসন্তান অবস্থায় অকালে মৃত্যুবরন করেন, তাহার অকাল মৃত্যুতে সমুদয় সম্পত্তির অধিকারী হন মরহুমা তহরুন নেছা চৌধুরী। উভয় সূত্রে সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী শেলবর্ষ পরগণার বিশাল জমিদারীর মালিক হয়েছিলেন। তাহাছারা তিনি কলকাতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তাহার জমিদারীকে সম্প্রসারন করেন। সৌভাগ্যক্রমে মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। তিনি উর্দু, আরবি ও পারসি ভাষায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন এবং তাহার ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও সৌজন্যপুরন ছিল। তিনি অতি দক্ষতার সহিত বিষয় সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন।
মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী সাহেব ”ব্রিটিশ এসোসিয়েশন অব বেঙ্গল ল্যান্ড লর্ড ”-এর সন্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের অস্ত্র আইনের প্রথম পরিচ্ছেদ ৯ (এফ) ধারা অনুসারে অস্ত্রসহ দশজন দেহরক্ষী রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের মনোনীত অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাহাছারা তিনি একাধারে বগুড়া জেলাবোর্ডের সদস্য, কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের কমিশনার এবং বগুড়া পৌরসভার সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নওয়াব উপাধিতে ভূষিত হন। তাহার এই উপাধি প্রদানকালে তৎকালীন বাংলার ছোট লাট গভর্নর চার্লস এলিয়ট শিক্ষা ও সমাজসেবামুলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। তিনি “ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন” বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা ও সমাজ সেবায় মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরীর অবদানঃমরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী বগুড়ায় স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজ সেবামুলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। সভা-সমিতি গঠন ও শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নয়নের জন্য অবদান রাখতে সক্ষম হন। তিনি ২১ ডিসেম্বর ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলার শিক্ষার্থীদের ভাল ফলাফলে উৎসাহিত এবং গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সুযোগ দানে জেলা শিক্ষা বিভাগে মাসিক আট টাকা হারে কয়েকটি শিক্ষা বৃওি (দুই বছরের জন্য), তিনটি বিশেষ পুরষ্কার এবং দুইটি মুল্যবান সন্মাননা পদক প্রদানের জন্য তিন হাজার টাকা প্রদান করেন, শিক্ষার্থীদের জন্য তাহার এই অনুদান অনেক সময়কাল ব‍্যাপী প্রচলিত ছিল।
মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী স্ত্রীলোকদিগের চিকিৎসার নিমিত্তে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি উক্ত দাতব্য চিকিৎসালয়টি তাহার পরলোকগত পত্নী ” তহুরুন্নেছা হাসপাতাল” নামে নামকরণ করেন। চিকিৎসালয়টির ব্যয় নির্বাহে বাষিক ১২০০০/- টাকা আয়ের ভূ-সম্পত্তি দান করেন এবং একজন মহিলা ডাক্তার নিযুক্ত করেন।এই মহিলা হাসপাতালটি বর্তমানে তহুরুন্নেছা মহিলা সংসদ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা স্থানীয় ভাষায় “মহিলা ক্লাব” হিসেবে বর্তমান আছে। একমাত্র কন্যা সন্তান আলতাফুন্নেছা খাতুন তাহার জীবদ্দশাতেই একমাত্র পুত্র সন্তান রেখে অকালে মৃত্যুবরণ করিলে তিনি শোকে পতিত হন এবং তাহার একমাত্র কন্যার নামে খেলার মাঠের জন্য জমি দান করেন। যা অদ্যবদী আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ নামে তাহার সুকৃতি পরিচয় বহন করছে।
মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী বগুড়ার প্রাচীনতম গ্রন্থাগার ” উডবার্ন ” লাইব্রেরীর জন্য একটি পাকা গৃহ নির্মাণ করেন যা আজও বর্তমান। তিনি বগুড়াতে নবাববাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাহাছারা তিনি বগুড়া জেলায় সাব-জজ আদালত, বগুড়া জামে মসজিদের মক্তব এবং ভিক্টোরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসা পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিনত হয়।
মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে সান্তাহার হতে বগুড়া শহরের মধ্য দিয়ে ফুলছড়ি ঘাট পর্যন্ত রেলপথ বসানো হয়। এই রেলপথ স্থাপনে তিনি রেল কোম্পানিকে নিজেস্ব বহু একর জমি দান করেন। নবাব সলিমুল্লাহর শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। ঐতিহাসিক লেখক প্রভাশচন্দ্র সেন বি.এল কতৃক রচিত “বগুড়ার ইতিহাস” নামে একখানা পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেন কিন্তু অর্থের অভাবে গ্রন্থটি মুদ্রণ করা সম্ভব হয় নাই। পরবর্তী সময়ে মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরী উক্ত গ্রন্থখানি মুদ্রনের ব্যবস্থা করিয়ে দেন।
### নোট: মরহুম সৈয়দ আব্দুস সুবাহান চৌধুরীর অবদান ছোট আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাহার ভাষণ, শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে গৃহিত প্রস্তাবনা সহ অনেক অবদান লেখা হয় নাই । ###
শিক্ষাবিস্তার এবং মানবসেবায় নিয়োজিত পথিকৃৎ মরহুম আব্দুস সুবাহান চৌধুরী ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরন করেন।

writer: Golam Zakaria Kanak

তথ্যসুত্র:বগুড়ার ইতিহাস- প্রভাস চন্দ্র সেন
বগুড়ার ইতিকাহিনী -কাজি মোহাম্মাদ মিছের
বগুড়া সেতিহাস- কালিকমল সার্ব্বভৌম

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button