বগুড়ার ইতিহাস
বগুড়া জেলা ও উপজেলার নামকরণের ইতিহাস
বগুড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে বলবন আমলে বাংলার শাসক নাসির-উদ-দিন বুগরা খানের নামানুসারে। বুগড়া খান ছিলেন দিল্লির সুলতান গিয়াস-উদ-দিন বলবনের কনিষ্ঠ পুত্র। বগুড়া জেলার উপজেলা সমুহঃ কাহালু উপজেলা, বগুড়া সদর, সারিয়াকান্দি, শাজাহানপুর, দুপচাচিঁয়া উপজেলা, আদমদিঘি উপজেলা, নন্দিগ্রাম, সোনাতলা উপজেলা, ধুনট উপজেলা, গাবতলী, শেরপুর উপজেলা, শিবগঞ্জ।
1. কাহালু উপজেলাজানা যায় দরবেশ গাজী জিয়া উদ্দীন সাহেবের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হযরত শাহ সুফী সৈয়দ কালু নামের এক দরবেশ এসে বর্তমান কাহালু থানার পার্শ্বে আস্তানা স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরন করেন। কাহালু থানার অভ্যন্তরে এই দরবেশের মাজার রয়েছে যা কালু বাবার মাজার নামে পরিচিত । এ সাধু পীরের নামানুসারে উপজেলার নামকরন হয়েছে‘‘কাহালু’’ বলে জনশ্রুতিতে প্রকাশ।
2. সারিয়াকান্দি উপজেলাঃঅতীতে নাম ছিল নওখিলা। মনসা নদী মজে যাওয়ার দরুন তৎকালীন নওখিলা থান সদর সারিয়াকান্দি নামে গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়।
3. শাজাহানপুর উপজেলাজনশ্রততি রয়েছে যে,ষোড়শ শতাব্দীতে করতোয়া নদী পথে মাঝে মাঝে মধ্য রাতে মাছ ধরা মাঝির বেশে জলদস্যুরা আসতো। এ অঞ্চলে লুটতরাজ করতো। ফলে সমস্ত এই জনপদের নাম হয়ে পড়ে মাঝিড়া। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সুবে-বাংলা এ সমস্যার কথা পত্রযোগে আগ্রাতে সম্রাট শাজাহানকে অবহিত করলেন। সম্রাট তাৎক্ষণিকভাবে সেনা ছাউনি সহাপনের জন্য এখানে একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। মোঘল সেনাদল এই উপজেলা সদরের ৭০০ গজ উত্তরে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পূর্ব পাশে ২৫/৩০ ফুট মাটি ভরাট করে সহানটিতে উঁচু ঢিবি তৈরি করে সেনা ছাউনি সহাপন করা হয়। যাতে সেই উঁচু ঢিবি হতে দিগমত বিসতৃত অঞ্চলে জলদস্যুদের যে কোন আনাগোনা বা গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। ধার্মিক সম্রাটের বদান্যতায় এই জনপদের মানুষ সন্ত্রাস আর দস্যুতা হতে পরিত্রাণ পায়। মোঘল সম্রাটের নাম অনুসারেই পুরো এলাকার নাম হয় শাজাহানপুর বা সাজাপুর। বৃটিশ আমল থেকে সকল রেকর্ড পত্রে মৌজাটির শাজাপুর নাম বহাল রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ উপজেলার নাম হয় শাজাহানপুর উপজেলা।
4. দুপচাচিয়া উপজেলাঃথানার নামকরণ কখন, কিভাবে হয়েছিল সে বিষয়ে ইতিহাস সমর্থিত কোন তথ্য প্রমানাদি পাওয়া না গেলেও এ থানার নামকরণ বিষয়ে প্রবীণ ব্যক্তিরা বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। এ থানায় এক সময় তাঁত শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। তখন ‘ধূপছায়া’ নামে এক ধরণের উন্নতমানের দামী তাঁতের শাড়ি তৈরী হতো। এই ‘ধূপছায়া’ শাড়ী হতেই এ থানার নাম হয় ধূপছাঁচিয়া। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনামলে তাঁত শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েই দুপচাঁচিয়া সদরে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে, যা সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রথমে বাঙ্গালী খ্রিষ্টিয়ানগণ প্রশিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে মুসলমান প্রশিক্ষক উক্ত তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকুরি করতেন, তাদের বংশধর এখনো দুপচাঁচিয়ায় রয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলতেন, এককালে হিন্দু প্রধান এলাকা হিসাবে এখানে প্রচুর ধোপী (ধোপা) শ্রেণির লোক বাস করতেন। সদরের পাইকপাড়া থেকে মাঝিপড়া হয়ে মহলদার পাড়ার মধ্য দিয়ে দুপচাঁচিয়া পাইলট হাই স্কুলের পশ্চিম ও দক্ষিণ পার্শ্বে মরাগাংগী নামক খাল ছিল। ধোপারা এখানে তাদের কাপড় ধোয়া ও শুকানোর কাজ করতেন। এই ধোপী বা ধোপা কথাটি থেকেই কালক্রমে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে ধোপচাঁচিয়া। অনেকে বলেন প্রাচীনকালে এ এলাকায় ধূপের চাষাবাদ ছিল। তা থেকে ধূপচাঁচিয়া। যা পরবর্তীতে দুপচাঁচিয়া নামে পরিচিতি পায়। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের খাঁর আমলে ভূমি জরিপ ও মৌজার নামকরণ প্রথম শুরু হয়। তখন থেকেই দুপচাঁচিয়া মৌজার সৃষ্টি হয়েছে বলে কথিত রয়েছে।
5. আদমদীঘি উপজেলাহযরত বাবা আদম (রঃ) এর পূণ্য স্মৃতি বিজড়িত এ আদমদীঘি উপজেলা। ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজা বল্লাল সেনের রাজত্বকালে উক্ত সুফি সাধক এর শুভ পদার্পণ ঘটে। তিনি এ অঞ্চলে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন এবং ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে জনকল্যাণে বৃহদাকার দীঘি খনন করেন। হযরত বাবা আদম (রঃ) এর খননকৃত দীঘির নাম অনুসারে এ অঞ্চল পরবর্তীতে ‘‘আদমদীঘি’’ নামে পরিচিতি লাভ করে। নাটোরের মহারাজার মহিয়সী পত্নী রানী ভবানীর জন্মস্থান এ আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ানগ্রামে।
6. নন্দীগ্রাম উপজেলাঃপুর্বে নন্দীগ্রাম নাটোরের সিংড়া থানার অধীনে ছিল।কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, রাজা দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাইয়ের নাম ছিল নন্দিনী। তিনি একদা এ অঞ্চলে বাস করতেন। বলা হয়, নন্দিনীর নামানুসারে নন্দীগ্রাম হয়েছে।
7. সোনাতলা উপজেলাঃসোনাতলা নামের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। সোনাতলা মৌজার নামানুসারে সোনাতলা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে।
8. ধুনট উপজেলাঃবলা হয়ে থাকে 18 শতকের শুরুর দিকে যমুনা নদীতে িএকটি চর জেগে উঠলে দুর্ধর্ষ ডাকাতদের একটি দল এইরে চরে আস্তানা গাড়ে। এই ডাকাতরা নদীপথে চলাচলকারী যাত্রীদের নিকট থেকে ধন-সম্পদসহ সর্বস্ব লুট করে নিতো। সময়ের বিবর্তনে এই চর এলাকা ধন-লুট নাম পরিচিত লাভ করে, যাক এক পর্যায়ে লোকমুখে ধুনট হয়ে যায়। অর্থাৎ ধন-লুট>ধুনট।
9. গাবতলী উপজেলাঃগাবতলীর প্রবীন ব্যক্তি জনাব মোবারক আলী আখন্দ তার ‘গাবতলীর ইতিকথা’য় লিখেছেন- আজ থেকে ৪৫/৪৬ বৎসর আগের কথা আমার বয়স তখন হবে আনুমানিক ১০/১২ বৎসর (১৯৩২) সাল। ঈদের দিন গ্রামের মধ্যপাড়ার ঈদের মাঠে সদলবলে আমরা দক্ষিণ পাড়ার লোকজন নামায পড়তে যাচ্ছি। গ্রামের প্রায় মাঝামাঝি গিয়েই রাস্তার বাম পাশে একটি প্রকান্ড কিন্তু নেড়ে ডাল-পালা নেই বললেই চলে এমন পুরাতন গাব গাছের উপর নজর পড়ে। মুসল্লি দলের মধ্যে কথা হচ্ছিল যে এই গাব গাছের নাম অনুসারেই গাবতলী গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে। এককালে গাবতলী এলাকায় প্রচুর গাব গাছ ছিল, যার নিদর্শন এখনও দেখা যায় গাবতলী গ্রামে। গাবতলী গ্রামের পিছন দিয়ে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বন-বাদাড় ছিল, ঘন গাছপালা ছিল। স্থানীয়ভাবে যা ‘আড়া’ নামে অভিহিত। সে আড়ার মধ্যে সব চেয়ে বেশী সংখ্যক চমকপ্রদ গাব গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম লাভ করত। ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে গাবতলী গ্রামের পিছন দিকের নিচু জমি দিয়ে বড় বড় পাট বোঝাই নৌকা গাবতলী সদর থেকে উত্তর দিকে ইছামতি নদী দিয়ে পীরগাছা হাট হয়ে রংপুর জেলার দিকে চলাচল করত, দক্ষিণ দিকে পোড়াদহ হয়ে যমুনা নদীতেও চলাচল করত। প্রাচীন এই গ্রামের বিভিন্ন স্থানে তাই নৌকার তলার কাঠ পাওয়া যেত।নাম কিভাবে সৃষ্টি হলো এটিই আমাদের মূল প্রতিপাদ্য। তথ্য যেহেতু নেই সেহেতু আমরা কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করতে পারি। ‘গাছের গাব লায়ের তলীএ্যাই লিয়া গাবতলী’ ‘লায়েল তলী’ অর্থাৎ নৌকার তলা। ‘লাও’ গাবতলীর কথা, যার অর্থ নৌকা। আর তলী মানে তলা। ‘মাটি কুয়া’ খুঁড়তে গিয়ে নৌকার কাঠ পেয়েছে অনেকে। এখনও মাটি কাটলে নৌকার কাঠ পাওয়া যায়। যার সম্ভাব্য কারণ- এ এলাকার মূল বাহণ ছিল নৌকা। গাবতলী এলাকাটি প্লাবিত জলরাশিতে নিমগ্ন ছিল, যার মধ্যে থেকে উঠে এসেছে এ ভূমি। কাজেই ‘গাছের গাব; লায়ের তলী, এ্যাই লিয়া’ গাবতলী এ শ্লোকটি হতে পারে গাবতলী নামকরণের একটি কার্যকারণ।
10. শেরপুর উপজেলামোঘল আমলে এ অঞ্চল কে বলা হতো ‘শেরপুর মুরচা’। আইন-ই-আকবরী ও আকবরনামা উভয় গ্রন্থেই এ স্থানের নাম শেরপুর মুরচা। বৃহত্তর শেরপুর থেকে এ স্থানকে আলাদাভাবে পরিচিত করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত ‘মুরচা’ নাম যোগ করা হয়েছিল। ফারসী মুরচা শব্দের অর্থ দুর্গ বা গড়। প্রাচীনকালে এখানে সোনাপুর নামে একটি নগর ছিল বলে জানা যায়। সম্রাট শেরশাহ’র আমলে সেই পুরনো শহরের ধ্বংসাবশেষের উপর একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠিত । সম্রাট নিজে বা তার কোন কর্মচারী সম্রাটের নামে এই নগর পত্তন করেছিলেন। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জন্য এ স্থান সুবিধাজনক বিবেচনায় এই শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
11. শিবগঞ্জ উপজেলাঃকথিত আছে যে, শিবগঞ্জ উপজেলা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা । পূর্বে এ এলাকায় হিন্দুদের পুজাপার্বনে অসংখ্য শিবমন্দির ছিল। শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে বন্দর-গঞ্জ গড়ে উঠে। এরই ফলশ্রূতিতে এ উপজেলার নাম শিবগঞ্জ করা হয়েছে ।