বগুড়ার ইতিহাস
বগুড়া সদরের সুপরিচিত শিক্ষক, নাট্যকার ও সাহিত্যিক তাজমিলুর রহমান সাহেবের জীবনী
শিক্ষক, নাট্যকার ও সাহিত্যিক তাজমিলুর রহমান সাহেব ১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলা শহরের রাজাপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত কর্ণপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মরহুম তৈয়ব উদ্দিন আহম্মদ বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক এবং মাতা মরহুমা হাসনা বানু গৃহিনী ছিলেন।
বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে তিনি তাঁহার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। তিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। অতঃপর তিনি সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে আই.এ পাশ করেন।
তাজমিলুর রহমান সাহেব অতঃপর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা সি.টি কলেজে বাংলা বিভাগে সন্মান শ্রেণীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। অতপঃর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তাজমিলুর রহমান সাহেব জুলাই ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সিভিল সাপ্লাই বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অক্টোবর ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে, তিনি স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে অব্যাহতি প্রদান করে বগুড়ায় ফিরে আসেন।
বগুড়ায় ফিরে তিনি প্রথমে গাবতলি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে কিছুকাল শিক্ষাদান করার পর জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া করনেশন ইন্সটিটিউশন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে অব্যাহতি প্রদান করে বগুড়া জিলা স্কুলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বদলি হয়ে দিনাজপুর জিলা স্কুলে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদন্নোতি লাভ করে বগুড়া জিলা স্কুলে বদলি প্রাপ্ত হন। তিনি জানুয়ারি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে বগুড়া জিলা স্কুলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদন্নোতি লাভ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে বর্বর দখলদার বাহিনীর পৈশাচিক তান্ডবে বগুড়া জিলা স্কুল যতেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিনি তৎকালীন সময়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুযোগ্য শিক্ষকবৃন্দের সহায়তায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্কুলকে পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং জিলা স্কুল’কে তার স্ব-মর্যাদায় ও স্ব-ঐতিহ্যে ফিরে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি, তাহার সুযোগ্য শিক্ষকবৃন্দের সহায়তায় তৎকালীন সময়ে বগুড়া জিলা স্কুলের শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১-১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল তারই সাক্ষ্য বহন করে। ছাত্র ভর্তির চাপ মোকাবেলার জন্য এবং অভিভাবকগনের ক্রমাগত অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নিকট আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি মহোদয় তাহা মঞ্জুর করিলে, বগুড়া জিলা স্কুলে ডাবল শিফট চালু হয়। তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে ৩ বছর সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ১০ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জিলা স্কুল হতে অবসর গ্রহণ করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি জানুয়ারি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে জানুয়ারি ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন স্কুল এন্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫-২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে খন্ডকালীন প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে তাহার ভুমিকাঃদিনাজপুরে অবস্থানকালে তাহার সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্য মজলিশ এবং দিনাজপুর সংস্কৃতি কেন্দ্রের সদস্য হয়ে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। সংগঠনের সদস্যদের উৎসাহে তিনি “অমৎসর” এবং “লঘুগুরু” নামক দুইটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তৎকালীন সময়ে দেশের প্রখ্যাত লেখক আবুল আবুল মনসুর এবং গাজী শামসুর রহমান “অমৎসর” গ্রন্থের অনেক প্রশংসা করেন।
৬০ দশকে নাট্যকার তাজমিলুর রহমান কিশোরদের জন্য নাটক লেখা শুরু করেন। কিশোরদের জন্য তার লেখা নাটক বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার লেখা উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো নিম্নরুপ: কলির জ্বীন, রুপচাঁদ, কারিগড় ইত্যাদি। তিনি রাজশাহী বেতারকেন্দ্রের আহ্বানে বেতার নাটক লিখেন। বেতার নাটকগুলোর মধ্য মহাস্থান, সীমান্ত এক্সপ্রেস, টোপ উল্লেখযোগ্য। বেতার নাটক মহাস্থান জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকার প্রচারিত হয়। তাজমিলুর রহমান বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তাহাঁর জীবনীমুলক লেখা দৈনিক অাজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা প্রত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। বগুড়া হতে প্রকাশিত করতোয়া দীর্ঘদিন কলাম লিখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থঃ প্রবন্ধঃ প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৬৪)শিশু সাহিত্যঃ কলির জ্বীন (১৯৫০), ভাই (১৯৫২), রুপচাঁদ (১৯৫২), সুবেহ উন্মিদ (১৯৫৬), কারিগর (১৯৫৬), কম্পজ্বর বিবরনী সভা (১৯৫২)।
কিশোর উপন্যাসঃজুলফিকারের অভিযান, সুন্দরবনে জুলফিকার, ভুতের কবলে জুলফিকার।রম্যরচনাঃ অমৎসর (১৯৬৫), লঘুগুরু (১৯৬৫)। নাটকঃ টোপ, অনেক আধাঁর পেড়িয়ে, যেমন খুশি সাজো। সীমান্ত এক্সপ্রেস, মহাস্থান, বাই প্রডাক্ট, কবুল কর্পোরেশন। পাঠ্য পুস্তকঃ সাহিত্য কথা, Learners English ইত্যাদি।
সাহিত্যিক তাজমিলুর রহমান বগুড়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে যতেষ্ট অবদান রাখেন। তিনি দীর্ঘদিন বগুড়া নাট্যগোষ্টীর কর্ণধার ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ হতে পরবর্তী পর্যায়ে বগুড়া নাট্যগোষ্টীর মাধ্যমে বহুসংখ্যক জনপ্রিয় নাটক মঞ্চায়ন এবং প্রতিযোগিতামুলক অভিনয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পুরস্কার গ্রহনে তাহাঁর যতেষ্ট অবদান ছিল। তাছাড়া বারয়ারি সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করে সাহিত্য আলোচনা ও প্রসারে কর্মরত ছিলেন। তিনি অধুনালুপ্ত “করতোয়া সাংস্কৃতিক অনুষদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।