বগুড়ার ইতিহাস
জাহাজ শিল্পের অগ্রপথিক বগুড়া জেলার ডঃ আব্দুল্লাহেল বারী সাহেবের জীবন চরিত
ডঃ আব্দুল্লাহেল বারী ১ জানুয়ারী ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলার তৎকালীন সারিয়াকান্দি (বর্তমান সোনাতলা) উপজেলাধীন শিহিপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাহার পিতা মরহুম মৌলবি তছির উদ্দিন আহম্মেদ (প্রকৌশলী) এবং মাতা মরহুমা গোলে আমেনা খাতুন (গৃহিণী) ছিলেন।
জনাব বারী ছেলেবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। মাতা-পিতার ৬ পুত্র ও ৪ জন কন্যা সন্তানের মধ্য তাহার অবস্থান ৬ষ্ঠ। তাহাঁর জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা মরহুম গোলাম রব্বানী (উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা), প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মোঃ গোলাম রহমান (লালমনিরহাট সরকারি কলেজ), মরহুম আমিনুর রহমান (সাবেক উপপরিচালক,পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর)।
শিক্ষাজীবনঃডঃ আব্দুল্লাহেল বারী নওদাবগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তিনি তাহার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। অত্যন্ত মেধাবী জনাব ডঃ আব্দুল্লাহেল বারী প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। অতঃপর তিনি সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ের কিংবদন্তি প্রধান শিক্ষক মরহুম সালেক উদ্দিন আহম্মেদের মাধ্যমে সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
জনাব বারী ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে সরাসরি ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। তিনি ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে (রাজশাহী বোর্ড) সন্মিলিত মেধাতালিকায় ২য় স্থান লাভ করেন।
তিনি বগুড়া জিলা স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় জেলা ব্যাপী মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতা (তোমার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব শীর্ষক রচনা) লিখে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। অতঃপর তিনি রাজশাহী গভঃ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী গভঃ কলেজ ( বিজ্ঞান বিভাগ) থেকে সন্মিলিত মেধাতালিকায় ৯ম স্থান লাভ করেন।
জনাব বারী উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় কৃতকার্য হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৌ-স্থাপত্য ও নৌযান প্রকৌশল বিভাগের প্রথম ব্যাচে প্রথম শ্রেণিতে ”প্রথম স্থান” অর্জন করেন।
কর্মজীবনঃবর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (BIWTA) সহকারী নৌ স্থপতি পদে যোগদান করেন। তাহার প্রত্যুতপন্নমতিতা, অসাধারন কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা এবং সততা বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ তাকে নৌ স্থপতি পদে তড়িৎ পদোন্নতি প্রদান করেন। সংশ্লিষ্ঠ অধিক্ষেত্রে তাহার বুৎপত্তি বিবেচনায় সরকার ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআই ডব্লিউটিএ)-এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ জরিপকারক হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন প্রদান করেন। কর্তৃপক্ষের ”মেকানাইজেশন অব কান্ট্রিবোট” প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রচলন করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নদী পথে মালামাল পরিবহণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের জাহাজ নির্মাণের ডিজাইন, ড্রয়িং-এর নৌ-স্থাপত্য প্রকৌশল সন্মত অনুমোদন পদ্ধতির সূচনা করেন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত সময়ে তিনি প্রডাকশন প্লানিং কন্ট্রোল, শিপস্ ক্লাসিফিকেশন রুলস্ এবং জাহাজের রেজিস্ট্যান্স-প্রপালশনে যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ডের Delft University- হতে বিশেষ শিক্ষা গ্রহন করেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কমনওয়েলথ স্কলারশীপ প্রাপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে এসে তিনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ সংস্হায় প্রধান প্রকৌশলী (নৌ নির্মাণ ও পরিকল্পনা) পদে যোগ দেন । ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
পিএইচডি অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি জাহাজ নির্মাণে বিপুল কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভবনা সম্যক উপলব্ধি করেন। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে তথা শিহিপুর গ্রামে আসার সময় তাকে স্বাগত জানানোর জন্য সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয়, শিহিপুর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়, এবং সৈয়দ আহম্মেদ কলেজের ছাত্র- ছাত্রীদের একত্রীত করা হয়। তাকে ষ্টেশন থেকে গ্রহন অত্র এলাকার প্রতিষ্ঠান সমুহের শিক্ষক বৃন্দ, অভিভাবক বৃন্দ, ছাত্র-ছাত্রীর সমন্বয়ে একটি রালি অত্র এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসাবে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে অবসর গ্রহন করে আনন্দ বিল্ডাস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অদ্যাবদি প্রায় ৩২০ টি বিভিন্ন আকার ও প্রকৃতির জলজান নির্মাণ করে সুনামের সাথে সরবরাহ করেন। তাহার প্রতিষ্ঠানে প্রস্তুতকৃত ১২ টি জাহাজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। ৩ টি বৃহৎ জাহাজ জার্মানিতে রপ্তানির প্রক্রিয়া চলমান। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ শিপইয়ার্ড এন্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড কর্তৃক নির্মিত সমুদ্রগামী জাহাজ নেদারলেন্ডে রপ্তানি হয় এবং একই সালের সেপ্টেম্বর মাসে হামবুরগে অনুষ্ঠিত SMM সন্মেলনে বাংলাদেশকে প্রথম জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। যা বাংলাদেশের সুনাম অর্জনে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়। তাকে অনুসরন করে বাংলাদেশে আরও শিপইয়ার্ড গড়ে উঠেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজের প্রতিষ্ঠানে ব্যাবহারের জন্য একটি দেশীয় ড্রেজারের ডিজাইন করে নির্মাণ করেন, পরবর্তীতে মাটি উত্তোলন ও সরবরাহের দেশীয় প্রযুক্তির এই ড্রেজার দেশের উন্নয়নে বৈপ্লবিক ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিজের মেধা,উদ্যম,পরিশ্রম, সততার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি Zarina Composite Textile Industries Ltd, Ananda Slipways & Slipways Ltd, Ananda Shipping Lines Ltd, Ananda El- Dorado Ltd, Ananda Bag Mills Ltd, Ananda Builders Ltd. প্রতিষ্ঠান সমুহের সমন্বয়ে Ananda Group গড়ে তোলেন। তিনি ঐ গ্রুপ অব কোম্পানির সন্মানিত চেয়ারম্যান ।
ডঃ আব্দুল্লাহেল বারী বাংলাদেশে এবং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সন্মানের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে দ্য রয়েল ইনষ্টিটটিউশন অব নেভাল আর্কিটেক্টস এর সন্মানিত সদস্য মনোনীত হন। তিনি ঐ ইনষ্টিটটিউশনের একজন ফেলো। তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার ইনষ্টিটটিউশনের এর ফেলো এবং সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি এসোসিয়েশন অব নেভাল আর্কিটেক্টস এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এর প্রেসিডেন্ট এবং এসোসিয়েশন অব এক্সপার্ট ওরিয়েন্টেড শিপবিল্ডিং ইন্ডা্ষ্ট্রিজ এর সন্মানিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সন্মাননা গ্রহনঃ১. ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘‘Outstanding Corporate Leadership Award’’ সন্মাননা অর্জন করেন।২. বাংলাদেশের রপ্তানী বাণিজ্যে অসাধারণ সাফল্যে স্বীকৃতিসরূপ তাহার প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড এন্ড শ্লিপওয়েজ লিঃ ঢাকা ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে ‘‘অন্যান্য শিল্পজাত’’ পণ্য জাতীয় রপ্তানী ট্রফি(স্বর্ণ)গ্রহন করে।৩. ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে কোরিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি সন্মাননা গ্রহন।৪. ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে নাট্যসভা কর্তৃক ‘‘মিডিয়া ব্যক্তিত্ব’’ সন্মাননা অর্জন।৫. ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে Arthakantha Business Award (Lifetime achievement in Shipbuilding) অর্জন।৬. ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক কর্তৃক সন্মাননা অর্জন।৭. ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলার শিহিপুর এলাকার ‘‘কৃতি সন্তান’’ হিসেবে সন্মাননা অর্জন।৮. ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ‘‘Bangladesh Indenting Agent’s Association Engineering ’’ কর্তৃক সন্মাননা অর্জন।৯. ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে Depart Of Naval Architecture and Marine হতে ‘‘আজীবন সন্মাননা’’ অর্জন।১০. ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাহাজ শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য BFTI National Shipbuilding Conference -এ তাহাকে বিশেষ সন্মাননা পুরষ্কারে ভূষিত হন।তাহাছারা বিভিন্ন ব্যাংক, প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে একাধিকবার সন্মাননা অর্জন করেন।
সমাজ সেবায় তাহার অবদানঃ১. তিনি তাহাঁর নিজ গ্রামের সহ অন্যান্য এলাকার সাধারন মানুষের নিকট আর্থিক সাহায্য সেবায় একজন নিবেদিত প্রান হিসেবে পরিচিত। ২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহে সহযোগিতাঃ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং সম্প্রসারণে তিনি এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহে বিভিন্ন উন্নয়নে বাবদ তিনি অনেক অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। ৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহে তাহার অবদানঃতিনি তাহাঁর সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভাল পরিবেশে শিক্ষালাভের সুযোগ দানের লক্ষে তিনি প্রতিটি শ্রেণী কক্ষের জন্য ৪ টি করে সর্বমোট ৩২ টি বৈদ্যুতিক পাখা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট অর্পণ করেন। ৪. তাহাছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করার লক্ষে সুখান পুকুর উচ্চ বিদ্যালয়, সুখান পুকুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং শিহিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীদের ফলজ এবং বনজ বৃক্ষ প্রদান করেন এবং বিদ্যালয়ে পতিত জায়গাগুলোতে বনায়নের লক্ষে চারা বৃক্ষ এবং রোপণ ব্যয় বাবদ নগদ অর্থ প্রদান করেন।
৫. তিনি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তাহার নিজ গ্রাম শিহিপুর সহ সুখান পুকুর, নওদাবগা গ্রামের সাধারন মানুষের পানীয় সমস্যা দূরীকরণের লক্ষে অর্ধশত পরিবারে নলকূপ স্থাপনে ভুমিকা পালন করেন।
লেখক ও তথ্যসংগ্রহাকঃ গোলাম জাকারিয়া কনকতথ্যসূত্রঃ ডঃ আব্দুল্লাহেল বারী সাহেবের সাক্ষাৎকার।