বগুড়ার জামিল মাদরাসা: সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অনন্য প্রতিষ্ঠান
আল-জামিআতুল ইসলামিয়া কাসিমুল উলূম। তুলনামূলক অনগ্রসর উত্তরবঙ্গের দারিদ্র্যপীড়িত সরল সুবোধ মানুষের মাঝে শিক্ষার সম্প্রসারণ, ও তাদের ঈমান-আমালের সংরক্ষণে ছয় দশক যাবত বিনিময় বিহীন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। বগুড়ার পুলিশ লাইন’স সংলগ্ন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এর উত্তর পশ্চিম পার্শ্বে প্রায় ৪০ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসাটি দেশব্যাপী জামিল মাদরাসা নামেই পরিচিত। ৪৭ সালে দেশভাগ ও পরবর্তী সময়ে ‘জামিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর মালিক পরিবার সম্ভ্রান্ত এবং দ্বীনদার হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত ছিল। মালিক আবদুল গফুরের পাঁচ ছেলের বড়জন মাওলানা সুহাইল উদ্দীন ছিলেন দেওবন্দ ফারেগ আলেম। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান। পিতা আবদুল গাফুর তাঁর বড়ছেলে মাওলানা সুহাইল উদ্দীনকে বগুড়া অঞ্চলে একটি মাদরাসা করার নির্দেশ দেন। ১৯৫৭ সাল। মাওলানা সুহাইল উদ্দীন কোনো এক কারণে চট্টগ্রাম সফর করেন। হাটহাজারী, পটিয়া ও জিরি মাদরাসা পরিদর্শন করে বগুড়াতেও একটি মাদরাসা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত তখন পাকাপোক্ত করেন। মাওলানা সুহাইল উদ্দীন পটিয়া মাদরাসার তদানীং মুহতামিম মুফতি আযিযুল হক রহ.-এর কাছে নিজের মনের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে দোয়া ও পরামর্শ কামনা করেন। যার প্রেক্ষিতে মুফতি সাহেব পটিয়া মাদরাসার পৃষ্টপোষক ও পরবর্তী মুহতামিম মাওলানা ইউনুছ রহ. সহ আরো কয়েকজন উস্তায নিয়ে বগুড়ায় সফর করেন এবং ১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি নিজ হাতে কাসেমুল উলূম জামিল মাদরাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। শিক্ষাকার্যক্রমসহ মাদরাসার অভ্যন্তরীন বিষয়ের নেগরানির জন্য একজন উপযুক্ত লোক তলব করা হলে পটিয়ার মুফতি আযিযুল হক্ব রহ. জামিয়ার তৎকালীন প্রবীণ উস্তায মুফতি আবদুর রহমান রহ. কে পাঠালেন। বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ফকীহুল মিল্লাত খ্যাত এ আলেম বগুড়ায় এসে জামিল মাদরাসার হাল ধরেন। অল্পদিনেই মাদরাসা ক্রমধারায় উন্নত হতে থাকে। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম তাকমীল জামাত খুলে নিয়মতান্ত্রিক হাদীসের দরস শুরু হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জামিল গ্রুপের মালিক পক্ষ করাচি চলে গেলে মাদরাসা সাময়িক সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যায়। তবে তৎকালীন বগুড়া জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা জনাব আবদুল কাইয়ূমের কর্মতৎপরতায় মাদরাসা আবার প্রাণ ফিরে পায়। এসময় দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের প্রভাব মাদরাসার উপরও পড়ে। তবে মাদরাসা টিকিয়ে রাখার জন্য উস্তাযরা খাদ্য ও অর্থ সঙ্কট সত্ত্বেও বিনা বেতনেই ছাত্রদের পড়াচ্ছিলেন। ১৯৭৭ সাল। মাদরাসার চরম দুর্দিনে পটিয়া মাদরাসার সেসময়ের মুহতামিম মাওলানা ইউনুছ রহ.-এর সাথে পরামর্শ করলে তিনি জামিল মাদরাসার সুযোগ্য ছাত্র মাওলানা ইউছুফ নিযামীকে মুহতামিম এবং মাওলানা ইয়াকুব সাহেবকে নায়েবে মুহতামিম নিযুক্ত করে আল্লাহর উপর ভরসা করে মাদরাসা চালাতে বললেন। নিতান্তই অনীহা ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও উস্তায ও মুরুব্বীদের নির্দেশ পালনে মাদরাসা পরিচালনার গুরু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন মাওলানা ইউছুফ নিযামী রহ.। আল্লাহ তাআলার অশেষ অনুগ্রহ ও দ্বীনদার মানুষের একান্ত সহযোগিতায় ইনতিকাল পর্যন্ত ৩৩ বছর পর্যন্ত পরিচালনা করে মাদরাসাকে নিয়ে যান উন্নতির চূড়ান্ত সীমায়। ইউছুফ নিযামী রহ.-এর ইনতিকালের পর পুনরায় মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ মুফতি আবদুর রহমান রহ.। ২০১৫ সালে মুফতি মুফতি সাহেবের ইনতিকালের পর থেকে মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম মুফতি আরশাদ রহমানী। নগরের কোলাহলমুক্ত চতুর্দিকে গাছের ছায়াবেষ্টিত একাধিক সুরম্য ভবনের জামিল মাদরাসায় বর্তমান ছাত্র সংখ্যা প্রায় ২৫ শত। ইফতা, আদব, কিরাতসহ অন্যান্য বিভাগে তারা অধ্যয়ন করছেন। বগুড়ার স্থানীয় আলেম লেখক, জামিল মাদরাসার সাবেক ছাত্র মাওলানা সালাহুদ্দীন মাসউদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। ।। তারিক মুজিব ।।