পবিত্র আশুরা আজ
![](https://boguralive.com/wp-content/uploads/2019/09/cropped-IMG_20190910_104354_621.jpg)
পবিত্র আশুরা- ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। মহাকালের পালাবদলে বছর ঘুরে আবারো আসছে অগণিত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, উত্থান-পতন ও সৃষ্টি-ধ্বংসের স্মৃতি বিজরিত এ ঐতিহাসিক দিন । সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মহান আল্লাহ্ তায়ালা এ আশুরার দিনে এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা এ দিনকে বছরের অন্যান্য দিন অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করেছে। ফলে এ দিনটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সমগ্র মানবকুলের জন্য পরম পবিত্র ও বরকতময়।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র হাদীসে কুদছিতে এরশাদ করেন, “কুনতু কানজাম মুগফিয়ান ফা আহবাবতু আন উরাফা ফা খালাকতুল খাল্কা লিউরাফা”-“আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার-নিজেকে প্রকাশ করতে ভালবাসলাম তাই সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলাম।” এ পবিত্র আশুরার দিনে পরম প্রভু নিজেকে প্রকাশের জন্য সমগ্র মাখকলুকাতকে সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়ে আত্মাময় জগৎ- আলমে আরোহয়াতে সমবেত আত্মাসমূহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আল আছতু বি রাব্বিকুম”- “আমি কি তোমাদের প্রভু নই?” সবাই জবাব দিয়েছিল, “বালা”-নিশ্চয়। পবিত্র আশুরা প্রভু হিসেবে আল্লাহর অভিষেকের দিন বলেই বছরের সবচেয়ে পবিত্রতম, রহমতপূর্ণ ও বরকতময় দিন হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখ যায়, মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র আশুরার দিনেই আরশ, কুরছি, লওহো, কলম, আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছিলেন। এ দিনেই মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁকে এদিনে বেহেশতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে এদিনেই দুনিয়াতে পাঠিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন। হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগে তিনি সাড়ে নয়শত বছর যাবৎ তাওহীদের বাণী প্রচারের পর যখন সে যুগের মানুষ আল্লাহর বিধি-নিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন নেমে আসে গজব। ফলে হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় হয়েছে কোপগ্রস্ত। আর রক্ষা পায় শুধু তাওহীদে বিশ্বাসী হযরত নূহ (আঃ)-এর অনুসারীবৃন্দ। পবিত্র আশুরার দিনেই মহা প্লাবন কালে হযরত নূহ (আঃ)-এর নৌকা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জুদী পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। পবিত্র আশুরার এ দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ভূমিষ্ট হন। পরবর্তীতে তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার লাভ করেন এবং নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে খলিলুল্লাহ্ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন পবিত্র আশুরার এই দিনে।
পবিত্র আশুরার দিনে হযরত আইউব (আঃ) রোগমুক্ত হয়েছিলেন; হযরত ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং চতুর্থ আসমানে উত্থিত হয়েছিলেন। হযরত দাউদ (আঃ) আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছিলেন; হযরত সোলায়মান (আঃ) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন; হযরত ইউনুছ (আঃ) মাছের পেট হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন; হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পেয়েছিলেন। পবিত্র আশুরার দিন ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসা (আঃ)-কে গ্রহণ করেছিলেন; আবার স্বীয় কওমের লোকজনসহ হযরত মুসা (আঃ) নীলদরিয়া অতিক্রম করেন। পক্ষান্তরে ফেরাউন সদলবলে নীলদরিয়ায় ডুবে মৃত্যুবরণ করে। পবিত্র আশুরা সমগ্র জগৎ সৃষ্টির দিন হিসেবে যেমন স্বীকৃত, তেমনি এদিন কেয়ামতের মহাপ্রলয় সংঘটিত হয়ে জগৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এ পবিত্র দিনে এমনি আরো বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। পবিত্র আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের কাছে যে কারণে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয় বিদারক, তাহলো- এদিনেই দুরাচারী এজিদবাহিনী সাইয়্যেদুল আম্বিয়া, সর্দারে দোআলম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতবা (সঃ)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমীরুল মু’মেনীন শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর হৃদয়ের ধন, মোহাম্মদী ইসলামের অকুতভয় সৈনিক ইমাম হোসাইন (রাঃ)-কে সপরিবারে কারবালার মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ করে।
কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার পর মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী মুসলমানগণ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেদের ঐতিহ্য ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিম জাতি বিশ্বের সেরা জাতি হওয়া সত্ত্বেও বিধর্মীদের হাতে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হয়। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে চক্রান্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর যে মহান আদর্শ তথা সূফীবাদ কালের অতলে তলিয়ে গেছে, ইসলামের সেই মৌলিক শিক্ষাকে পুনঃরুজ্জীবিত করে জগৎবাসীর কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে আজ থেকে ৩৪ বছর পূর্বে যুগের মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মাঃ আঃ) হুজুর কেব্লা পবিত্র আশুরার এই দিনে দেওয়ানবাগ শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। তাই এ দিনটি কেবলমাত্র মুসলিম জাতির জন্য নয়, ইহা সমগ্র মানব জাতির নিকট অতীব পবিত্র ও সম্মানিত।
বস্তুতঃ পবিত্র আশুরা মানব জাতির জন্য আল্লাহর রহমত লাভের এক মোক্ষম সুযোগ। আমরা যদি এ দিনটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করতে সক্ষম হই, তবে আল্লাহর অবারিত রহমত ও হযরত রাসূল (সঃ)-এর নেকদৃষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে আমাদের ইহলৌকিক জীবন হবে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী এবং পারলৌকিক জীবনও হবে শান্তি ও কল্যাণময়। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পবিত্র আশুরা পালনের তাওফিক দান করুন। আমীন।
শেখ শানিম হাসান রুদ্র।