তারুণ্যের কন্ঠস্বর

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও বাংলাদেশ | হিমেল আহমেদ

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও বাংলাদেশ

খাদ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে শক্তি সঞ্চয় হয়। তাই সূষম খাদ্য গ্রহণের অধিকার রয়েছে সবার। প্রতিদিন মানুষ কত খাদ্য খাচ্ছে তার নির্দিষ্ট পরিমান আমাদের জানা নেই। তবে বিশ্বজুড়ে খাদ্য অপচয়ের ক্রমবর্ধমান বিষয়টি আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। আমরা প্রতিদিন যত খাদ্য অপচয় কিংবা নষ্ট করছি তা যদি অনাহারীদের বিলিয়ে দিতাম তাহলে দারিদ্রতা অনেকটাই কমত! খাদ্য অপচয়ের এই সমস্যাটা দিন দিন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে যা প্রতিরোধ করাও যাচ্ছেনা। একটি রাষ্ট্র কিংবা দেশের সমস্যা নয় এটি বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যায় পরিনিত হয়েছে। সম্প্রতি  জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে যে  প্রতিবছর পুরো বিশ্বে প্রায় ১৪০ কোটি টন খাদ্য অপচয় করা হচ্ছে। যা বিশ্বের খাদ্য যোগানের এক-তৃতীয়াংশ!  যা দিয়ে বছরে ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভড়ে খাওয়ানো সম্ভব! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমরাই প্রতিবছর বিশাল এই পরিমান খাদ্য অপচয় করছি। জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত অয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বছরে খাদ্য নষ্টের আর্থিক মূল্য ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর উন্নয়নশীল দেশে এর পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। ধনী দেশগুলোতে ভোক্তারা বছরে ২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবার নষ্ট করেন। যা দিয়ে বিশ্বের ৮৭ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যেত! যার প্রধান কারন হয়ত আমাদের অসচেতনতা। আমরা যারা অতি সহজেই পেট ভরে আহার গ্রহণ করতে পারছি  অনাহারীদের নিয়ে  বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমাদের নেই! বিজ্ঞানীরা খাদ্য অপচয়কে বিশ্বের অন্যতম এক প্রধান সমস্যায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।  অতিরিক্ত খাদ্য অপচয় একদিকে আমাদের বিলাসিতার পরিচয় দিচ্ছে পক্ষান্তরে বিশ্বের একপ্রান্ত অনাহারে মরছে!  যতদিন যাচ্ছে এই অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

২০১৯ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ২০১৫ সালে যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৮৫ মিলিয়ন, সেখানে এবার তা বেড়ে হয়েছে ৮২২ মিলিয়ন।খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও জার্মানভিত্তিক সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড তাদের জরিপে বলছে ক্ষুধা নিবারণের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও রাজনৈতিক /অরাজনৈতিক বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা  থাকা সত্যেও গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ ক্ষুধা নিবারণের সূচকে দুই ধাপ উন্নতি করেছে। ১১৭ টি দেশের মধ্যে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮। বর্তমানে তা ৮৬ তে নেমে এসেছে। তবে এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই! বাংলাদেশে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মুল্য বাড়ছে। যেটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরী।  তবে খাদ্য অপচয়রোধ করা গেলে বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশ ক্ষুধা নিবারণে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী দেখার যে স্বপ্ন দেখছেন তা পুরন হওয়ার আশা খুবই কম বিজ্ঞানীদের কাছে। বিশ্বের কোথাও না কোথাও যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে। লড়াই করছে মানুষ স্বাধীনতার জন্য।এসবের স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া অলিক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়! বিশ্বের সবচেয়ে যুদ্ধাহত দেশ সিরিয়া, ফিলিস্তিন কিংবা ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কথা ভুলে গিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়া অসম্ভব।  সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে প্রায় আট বছর। আরব বসন্তের পর সশস্ত্র আন্দোলনের মুখে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে এখনো ক্ষমতায় রয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। কিন্তু বিদ্রোহী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ভেঙ্গে পড়েছে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা। বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন। ইয়েমেন  দেশটিকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই!  যুদ্ধাহত এই দেশটি আজ বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলীন হওয়ার উপক্রমে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের কবলে পরা দেশটিতে বর্তমানে গাছের পাতাও নেই খাওয়ার জন্য! আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ইয়েমেনে মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটছে। অথচ নিশ্চুপ রয়েছে বিশ্ব! প্রায় চার বছর ধরে এই যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে।এরমধ্যে শুধুমাত্র সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোটের হামলাতেই মারা গেছেন ৭৫ হাজারের বেশি ইয়েমেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট বা এসিএলইডির নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আর বাকি বাসিন্দারা না খেয়েই দুর্ভিক্ষের কারনেই মারা যাচ্ছে।যাদের অধিকাংশই রয়েছে শিশু। শুধু সিরিয়া,ইয়েমেন কিংবা ফিলিস্তিন নয়। বিশ্বের অভুক্ত সব মানুষের কথা ভাবতে হবে আমাদের।যে কাজটি সম্মিলিত ভাবে করতে হবে আমাদের। সুষম খাদ্য গ্রহণের অধিকার রয়েছে সবার। কিন্তু খাদ্য অপচয় কিংবা বিনষ্ট করার অধিকার কারো নেই। আমাদের সচেতনতা ও একটু  সাহায্যের হাত অনাহারীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনাহারী মানুষের সংখ্যা কম নেই! আর খাদ্য নষ্টতেও আমরা পিছিয়ে নেই। ফসল কাটা থেকে শুরু করে থালায় আসা পর্যন্ত প্রচুর খাদ্য নষ্ট হয়।  বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের একটি গবেষণায় জানা গেছে যে ফসল কাটার পরের পর্যায়ে উৎপাদনের মোট ১০ শতাংশ নষ্ট হয়।

২০১৮ সালে মোট উৎপাদিত ধানের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। গবেষণার ফল অনুযায়ী, প্রায় ৩৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে। দেশের শহরগুলোতে খাদ্য নষ্টের সংস্কৃতি বেশি! বাংলাদেশের ওয়েস্ট ডেটাবেইস ২০১৪ অনুসারে শহরগুলোর কঠিন আবর্জনার প্রায় ৬৮ শতাংশ হচ্ছে খাবার আর সবজি। এত্ত পরিমানে খাদ্য ফেলে দিয়ে নষ্ট করা হয়েছে। এই জরিপে স্পষ্ট  বুঝা যায় আমরা খাদ্য বিষয়ে কতটা সচেতন। জাতীয় পত্রিকার একটি প্রতিবেদন বলছে  গবেষকরা বাংলাদেশে খাবার নষ্টের দুইটি কারন খুঁজে বের করেছেন। একটি হল চাষ, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ আর সরবরাহের সময়ে। আর দ্বিতীয়  ভোক্তার কাছে খাবার বিক্রি, রান্না ও খাবার সময়ে। এই ছাড়া কৃষকেরা সঠিক পূর্বাভাস না পেলে একই ফসল বেশি চাষ করেন। ফলে জোগান অতিরিক্ত হয়ে গেলে উৎপাদন নষ্ট হয়। দেশে নগরায়ণ বাড়ার ফলে খাদ্য উৎপাদনের জায়গা থেকে ভোক্তার দূরত্ব বাড়ছে। তাই পরিবহনের সময়ে বেশি লাগায় খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দুঃখের খবর হল দেশে অপুষ্টিতে ভোগা লোকের সংখ্যা কম না!

চলতি বছর ( ২০১৯)   জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন ও বৈশ্বিক কৃষি পরিসংখ্যান প্রতিবেদন এবং দুটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার তৈরি করা বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ গুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। তারপরও আগের তুলনায় গত বছর দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে চার লাখ। এখনো দেশের অর্ধেক গর্ভবতী নারী রক্তশূন্যতায় ভোগেন। মানুষের দৈনিক খাদ্যশক্তি গ্রহণের পরিমাণ বৈশ্বিক ন্যূনতম মানে পৌঁছাতে পারেনি। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণেও পিছিয়ে আছি আমরা। সুষম খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্য অপচয় বিষয়ে সচেতন হতে হবে।  ইতিমধ্যে ইতালি,ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশে খাদ্য নষ্ট ও অপচয়ের বিরুদ্ধে আইন তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশেও এমন আইন হওয়া উচিত। তবে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অনেক সামাজিক সংগঠনগুলো বেচে যাওয়া খাদ্য অনাহারীদের মুখে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যে উদ্যোগকে আমাদের সবার সাধুবাদ জানানো উচিত।

আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে খাদ্য নষ্ট ও অপচয়  বিষয়ে সজাগ ও সেচ্ছাসেবী মনোভাব নিয়ে  কাজ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণে সরকারের নজরদারি প্রয়োজন। অতিরিক্ত উৎপাদিত খাদ্য যেন নষ্ট না হয়ে যায় সে বিষয়ে সরকারকে খেয়াল রাখা উচিত। আসুন আমরা সবাই খাদ্য নষ্ট ও অপচয় থেকে বিরত থাকি। ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করি।

লেখকঃ হিমেল আহমেদ
কলামিস্ট, সেচ্ছাসেবী, বগুড়া।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button