পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে নারীরা যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন
বহু বছর মানুষের ঘুম নিয়ে গবেষণা করার জন্যে শুধুমাত্র পুরুষদের ওপরেই পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তবে এখন সেই চিত্র বদলাচ্ছে। ঘুম নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের অনেকেই এখন নারীদের পর্যবেক্ষণ করছেন। এতে করে পুরুষ আর নারীর ঘুমের মধ্যে যেসব পার্থক্য আছে, তা একে একে সামনে আসছে।
এই পার্থক্যগুলির পেছনে হরমোন একটা বড় কারণ। মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক কর্মকাণ্ড আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন অথবা টেস্টোস্টেরন এর মতো হরমোন এসব কর্মকাণ্ডে প্রভাব রাখতে পারে।
সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল, গর্ভাবস্থা বা পিরিয়ডের সময় নারীদের হরমোনে পরিবর্তন দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়গুলিতে নারীরা ঘুমের সমস্যায় ভুগতে পারেন। তাদের অ্যাপনিয়া নামের ঘুমের ব্যাঘাতজনিত রোগ ছাড়াও অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া দেখা দিতে পারে। এছাড়াও রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম নামের একধরনের শারীরিক অসুস্থতাও তাদের মধ্যে দেখা যেতে পারে।
নারীদের ঘুমের সমস্যা হলে তারা পুরুষদের চাইতে বেশি কষ্ট ভোগ করে। ঘুমের সমস্যায় ভুগতে থাকা পুরুষের তুলনায় যেকোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে নারীদের বেশি বেগ পেতে হয়।
কিছুদিন আগে একটা গবেষণায় ১০ দিনের জন্য ১৬ জন পুরুষ এবং ১৮ জন নারীর ঘুমের অভ্যাস বদলে দিয়েছিলেন গবেষকরা। গবেষণা চলাকালীন সময়ে অংশগ্রহণকারীরা একটানা প্রায় ১৯ ঘণ্টা জেগে থাকতেন। এরপরে তাদেরকে মোটামুটি ৯ ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ দেয়া হতো। অর্থাৎ ঘুম আর জেগে থাকার সময় মিলে অংশগ্রহণকারীদের মোট ২৮ ঘণ্টার রুটিনের মধ্যে রাখা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে তাদের মস্তিষ্কের অবস্থা বোঝার জন্য কিছু কগনিটিভ পরীক্ষা করা হতো।
পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা কিছুটা বেশি সমস্যায় পড়েছে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে এই গবেষণা প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, রাতের শিফটে কাজ করা নারীরা কেন পুরুষের তুলনায় বেশি দুর্ঘটনায় পড়েন।
এছাড়াও ২০১৫ সালে কিশোর-কিশোরীদের উপরে আরেকটা গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, কর্মদিবসগুলিতে ঘুমের সমস্যা হলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংবেদনশীলতায় বেশি প্রভাব পড়ে।
পুরুষরা মাঝে-মধ্যে রাতের বেলায় নাক ডাকা অথবা দম বন্ধ হয়ে আসার সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। মূলত তখনই তাদেরকে অ্যাপনিয়া রোগের সম্ভাব্য রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের অ্যাপনিয়া রোগ হলে তাদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব আসা তেমনই একটা উপসর্গ। ডাক্তাররা সাধারণত এই ধরনের উপসর্গগুলি অ্যাপনিয়া রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করেন না।
এমনকি যখন নারীদের ঘুমের পরীক্ষা করা হয়, তখনও সঠিকভাবে তাদের রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।
ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের উইমেন’স স্লিপ হেলথ প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ক্রিস্টিন ওয়ান বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জানান, সাধারণত নারীদের ঘুমের র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা REM পর্যায়ে অ্যাপনিয়া’র লক্ষণ প্রকাশ পায়। অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণ ঘুমের যেকোনো সময়েই দেখা দিতে পারে। অ্যাপনিয়া নির্ণয় করা হয় একজন মানুষের সারা রাতের ঘুমের মধ্যে গড়ে কতক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হলো তার ওপর ভিত্তি করে। তবে শুধুমাত্র পুরুষদের ওপরে করা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই এই পদ্ধতিটি তৈরি করা হয়েছে। ফলে নারীদের অ্যাপনিয়া রোগ মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলেও ঘুমের REM পর্যায়ে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কারণে এটাকে বেশিরভাগ সময়ই খাটো করে দেখা হয়।
২০১৫ সালে করা এক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, অ্যাপনিয়া রোগে হার্টফেল করা আর মারা যাওয়ার ঝুঁকি পুরুষের চাইতে নারীর বেশি।
ওয়াশিংটনের অলাভজনক সংস্থা সোসাইটি ফর উইমেন’স হেলথ রিসার্চের সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিকা মলামপালি এই বিষয়ে তার মতামত জানান। তার মতে, “এসব রোগ নির্ণয় করতে স্ক্রিনিং এর যেসব যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম কিংবা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, সেগুলি তৈরি করা হয়েছে শুধুই পুরুষের কথা মাথায় রেখে। এগুলি নারীদের ওপর কাজ নাও করতে পারে।
# কারা সবচেয়ে বেশি ঘুমানোর সুযোগ পায় তাহলে?
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ১২৮ টি দেশের ৮,০০০ মানুষের ঘুমানো ও জেগে থাকার সময়কার ডেটা বিশ্লেষণ করেছিলেন। এই ডেটা সংগ্রহ করতে তারা একটি ফ্রি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষই আট ঘণ্টা ঘুমাতে পারে না। অথচ বিশেষজ্ঞরাই দৈনিক আট ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেন। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের লোকেরা গড়ে সবচেয়ে কম ঘুমায়। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি ঘুমায় ডাচরা। এই গবেষণা থেকে আরো যা যা জানা গেছে, তার মধ্যে কয়েকটা হলো:
• ঘুম ভাঙার পরে নারীরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৩০ মিনিট বেশি সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন
• মধ্যবয়সী পুরুষরা সবচেয়ে কম ঘুমান
• ২৪ ঘণ্টায় ঘুমের সময়টাতে যতক্ষণ ঘুমান, তার উপরেই নির্ভর করে আপনার ঘুমের চাহিদার কতটা পূরণ হচ্ছে