মানসিক স্বাস্থ্যে পরিবার ও প্রযুক্তি
বর্তমানে আমরা এমন একটি যুগ পাড় করছি যেখানে আগের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি ব্যস্ত! টেকনোলজি অনেক বেশি সহজলভ্য, তাই আমাদের বড় হওয়াটাও অনেক দ্রুত এবং আলাদা।
এসব কারনেই আমাদের মানসিক অবস্থা, ভাবনা চিন্তার সাথে আমাদের মা বাবার চিন্তা ভাবনার অনেকটা পার্থক্য থেকেই যায়। আবার এসব কারনে আমাদের যুগের একটা শিশুর মানসিক সুস্থতাটাও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর বর্তমানে এটা অনেক বড় একটি সমস্যা যা আমরা খুব বেশি আড়াল করে যেতে চাই। আমাদের এই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সব থেকে বড় ভূমিকাটাই রাখতে পারেন আমাদের পরিবার, এবং পরিবারিক সাপোর্ট।
“পরিবার” এটি এমন একটি শব্দ যা কিনা স্বভাবতই আমাদের কাছে সব থেকে ভরসার জায়গা। সব মানুষের জীবনেই পরিবারের আলাদা একটা ভূমিকা রয়েছে। আমাদের ভালো থাকার সকল দিকটিই তারা তাদের নজরে রাখেন। তবে নজর থেকে একটা জিনিস খুব সুক্ষ্ম ভাবে ফসকে যায় আর তা হলো, আমাদের মেন্টাল হেলথ বা মানসিক স্বাস্থ্য।
আমাদের দেশে সাইক্রিয়াটিস্ট যেখানে পাগলের ডাক্তার সেখানে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কথা বলা অনেকটাই উলু বনে মুক্তা ছড়ানো। আবার ডিপ্রেশন কিংবা ফাস্ট্রেশন এই কথা গুলো যখন উচ্চারণ করি তখন আপনাদেরই অনেকে বলে উঠবেন, “এই বয়সে আবার ওইসব কি? আমাদের সময় আমরা বড় হইনি? কই আমাদের তো এসব ছিল না।
আসলে আমরা সকলেই নিজেদের অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে অন্যেরটা বিচার করার চেষ্টা করি। আর এভাবেই সময়ের এই পার্থক্যটা গুলিয়ে ওঠে।
আজ অবশ্য আমি একই কাজ করছি। নিজের জায়গা থেকে আমার ভাবনা টা তুলে ধরার চেষ্টা করছি!!!
আমি একজন ১৮ বছর বয়সী কিশোরী কিংবা আমি একক পরিবারে বড় হচ্ছি যেখানে আমার মা বাবা দুজনেই চাকরিজীবি। আমি জানি আমার জীবনে মা বাবা, তথা পরিবারের সাপোর্টটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আসলেই কি সবাই পরিবারের কাছ থেকে সেই মানসিক সাপোর্টটা পায় যা তাদের পাওয়া দরকার?
এই ব্যপারে কথা বলার আগে আমি আমার দৃষ্টিতে আমাদের এই মানসিক অসুস্থতার একটি কারন নিয়ে কথা বলতে চাই।
আমি সব থেকে বড় দায়টা দেব সহজলভ্য টেকনোলজিকে।
হ্যাঁ! আমাদের জীবনে বর্তমানে এই অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসটাই আমাদের মানসিকতা আমাদের ভালো থাকা কে অনেক অনেক বেশি আঘাত করছে। বর্তমানে একটা শিশু জন্মের পর হাঁটতে শেখার আগে শিখে ফেলে টেকনোলজি ইউজ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি হয় মোবাইল ফোন।
শিশুর কান্না থামাতে হোক বা তাকে খেতে রাজি করাতে তার হাতে তুলে দেয়া হয় টেকনোলজি। আর তারপর সেই শিশুও বড় হতে থাকে সেই যন্ত্রটার উপর নির্ভর করে। হাটতে শেখার পরও অবশ্য হাত থেকে ছাড়ে নি তার হাতের ছড়ি। এই শহুরে ব্যস্ত জীবনে কত জনই বা পারে ছেলে মেয়েকে সেই দুরন্ত বিকেল বেলা ফিরিয়ে দিতে? না আছে সেই পরিস্থিতি না আছে সময়। তখন আরো পক্ত ভাবে হাতে বসে যায় সেই জাদুর বাক্স। ছোট থেকেই সে মানুষের সাথে সখ্যতার তুলনায় জাদুর বাক্সের শখ্যতা বেশি টের পেতে থাকে। নিজে নিজেই জানতে থাকে সেই জাদুর বাক্সের জাদু গুলো।
পারিবারিক সাপোর্ট থেকে দূরে রাখছে এই টেকনোলজি ব্যবহার। আর এ জন্যই তৈরী মানসিক বিপর্যয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ ‘আত্মহত্যা’! ২০১৬ সালে ১৭ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৩০। ২০০৩ সালে একই সংস্থার জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৬ জন। সেই হিসাবে ১৩ বছরের ব্যবধানে ওই বয়সী শিশু-কিশোরদের আত্মহত্যার সংখ্যা বছরে ২,২১৮ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১০,৯২১ জন। অর্থাৎ সময় যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের শিশু-কিশোররা ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয় এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর তাই আজ এই বিষয়কে পাগলামো কিংবা বোকামি হিসেবে না নিয়ে সমস্যা হিসেবে এর কিছু সমাধানের কথা ভাবছি। আর সেই সমাধান হিসেবে প্রথমেই মাথায় আসে পারিবারিক সাপোর্ট।
কেও চাইলেই এখন টেকনোলজি থেকে একজন শিশুকে দূরে রাখতে পারবে না। এতে যুগের সাথে সে তাল মেলাতে পারবে না, জানার পরিধি কমে যাবে। কিন্তু হ্যাঁ! পরিবার চাইলেই আমাদের শিখিয়ে দিতে পারেন কিভাবে তা ব্যবহার করতে হবে।
কেন বয়ঃসন্ধি নিয়ে আমাদের কানাকানি হবে? কেন আমার পরিবার আমাদের সঠিক সময়ে জানাতে পারবে না? কেন আমার দাড়া কি ভুল হতে পারে তা নিয়ে খোলা খুলি কথা বলতে পারেন না মা-বাবা। সারাদিন পড়াশোনার কথা না বলে ছেলে-মেয়েদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জায়গাটা দিতে পারেন।ছেলে-মেয়েরা কি করতে চায়, কি করতে ভালোবাসে সেই প্রাধান্যটা দিতে পারেন।সময়ের প্রতিযোগিতার সাথে না গুলিয়ে সন্তানের ভালো থাকাটা কে প্রাধান্য দেয়া দরকার। এতে সন্তানরা তাদের ভাবনা আপনাদের বলতে সাহস পাবো।
পরিবারই পারবে সন্তানদের ভুল গুলো বুঝে তাদের সঠিক দিকটা দেখাতে কারণ পরিবারই সবচেয়ে ভালো চায়।
এসব পড়ে মনে হতে পারে সন্তানরা যা খুশি করবে কিচ্ছু বলা যাবে না। কিন্তু আসলে তা নয়। সন্তান্দের ভুল ঠিক বুঝানোর দায়িত্বটা পারিবারই। তাই ছোট থেকেই সন্তানদের সময়ের সাথে উপযোগী ধারণা টুকু দিন। ভুল করলে শাষন করুন কিন্তু সন্তানরব ভুল করলে বা ভুল বুঝলে যেন আপনাদের নির্ভয়ে বলতে পারে সেই জায়গা টুকু করে দিন।সন্তানের যোগ্যতা সীমাবদ্ধ না করে দিয়ে নিজেকে নিয়ে খুশি থাকার সুযোগ দিন। শুধু পড়াশোনাটাই যেন তার একমাত্র মাপকাঠি না হয়। তার আঁকানো ছবি, তার গাওয়া গান, তার বিতর্কের স্ক্রিপ্ট, তার খেলার বল এসবও যেন তাদের গর্বের কারন হয়। সন্তানরা চায় তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ে সেই জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে আর সেই স্বপ্নে তারা পাশে চায় পরিবারকে।
সব মিলিয়ে সন্তানেরা প্রতিটি লড়াইয়ে তাদের বাবা-মাকে নির্ভয়ে পাশে চায়।