অপসংস্কৃতি ও তরুন সমাজ
সংষ্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি — আমাদের জীবন যাপন, কাজকর্ম, চালচলন, কথাবার্তা, আরো অনেক কিছু। প্রত্যেক জাতীর, প্রত্যেক গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা সংষ্কৃতি আছে। তবে আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করি বলে আমাদের একই এলাকায় সবার সংস্কৃতির কিছু সাধারণ রূপ দেখা যায়। মূলত জীবন যাপনের এই সাধারণ রূপকেই কোনো এলাকা বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বলা হয়।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। অনেকের সাথে মিলেমিশে থাকতে হলে একে অপরের কাজকে প্রত্যেকেরই শ্রদ্ধা করতে হবে। কাজকে শ্রদ্ধার মাধ্যমে সংস্কৃতি কে শ্রদ্ধা করা হয়। এর মাধ্যমে গড়ে উঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। প্রত্যেক সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি পালন করবে। অন্যরা সেটাকে সম্মান করবে। যদি গ্রহন করার মত হয়, তবে তা গ্রহন করতে পারে। গ্রহন করার মত না হলে এড়িয়ে চলতে হবে। প্রতিবাদ বা বিরোধ থেকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু সমাজ ব্যাবস্থাপনার জন্য তাই প্রত্যেকেরই একে অপরের সংস্কৃতি কে শ্রদ্ধা করতে হবে।
তবে বর্তমান কালের নতুন আরেকটি সামাজিক সমস্যা হলো অপসংস্কৃতি চর্চা। অপসংস্কৃতি বলতে আমরা কি বুঝি? আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ নয় এমন অনেক কাজ করাই অপসংস্কৃতি চর্চা। অনেকের দ্বারাই এই চর্চা সংঘটিত হলেও মূলভপ্রভাব পড়ে যুবসমাজের উপর। তথাকথিত ভদ্রলোকের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে মাটি চাপা দিচ্ছে দিনের পর দিন।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ বলে এখানে অনেক ধরনের সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়৷ প্রত্যেক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি আলাদা আলাদা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। একে অপরের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও তারা নিজ সংস্কৃতি কে অক্ষুণ্ণ মর্যাদায় রেখেছিলো। নিজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকার জন্য বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়।
পহেলা বৈশাখের কথাই ধরা যাক। একসময় বাঙ্গালির প্রানের উৎসবে মেতে ওঠার একমাত্র দিন ছিল এটি। কিন্তু অপরের সংস্কৃতি কে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা এ দিনটির মূল তাৎপর্য কে হারিয়ে ফেলেছি। একসময় পহেলা বৈশাখের মূল আকর্ষণ হালখাতা থাকলেও এখন তার জায়গা দখল করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল বিষয় হলো বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি বা অবয়ব। ইসলাম ধর্মে পৌত্তলিকতা হারাম। তবে অন্য ধর্মাবলম্বীরা এসব করলে বাধা দেওয়া যাবে না। মুসলিম দেশ হিসেবে অনেক মানুষ এসবের বিরূদ্ধে থাকলেও বেশীরভাগ মানুষই এর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।
তবে শুধুমাত্র অংশগ্রহণ টা বড় কথা নয়। শোভাযাত্রার সময় বিভিন্ন রকম অশালীন কাজ, যুবক যুবতীদের অবৈধ মেলামেশার চিত্র গণমাধ্যমের দ্বারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত মেলাগুলোতেও এই একই চিত্র চোখে পরে। এধরনের ঘটনা নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। আর দূষিত হচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতি।
অপসংস্কৃতির আরেকটি ভয়াল রূপ মাদকাসক্তি। পশ্চিমা দেশগুলোর সংস্কৃতি কে অনুসরণ করতে গিয়ে মাদকদ্রব্য সেবন করছে যুবকেরা। অকেশনালি সেবন করা থেকে নিয়মিত মাদক গ্রহনের প্রবনতা তৈরী হচ্ছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলো ঘর থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে পালন করা হচ্ছে। হাতের পরিবর্তে এসেছে কাটাচামচের সংস্কৃতি। অথচ নিয়মিত ব্যবহার এমন হয়ে গিয়েছে যে আমরা ভুলেই যাচ্চি এটা অন্যের সংস্কৃতি।
বর্তমান কালে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের কারনে এই অপসংস্কৃতি চর্চা আরো বেশী হচ্ছে। ট্রেন্ডের স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরছে অনেকেই। বাস্তব জীবন থেকে ছিটকে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতের মাঝে আটকে পরছে।
হাজার বছর ধরে লালিত বাংলার সংস্কৃতি কে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের তরুন প্রজন্মকে। আমরা সচেতন না হলে আমাদের সমাজ বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। তবে প্রশ্ন একটাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন অপরের সংস্কৃতিকে অনুসরন করব? তবে কি আমরা বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি? বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পদদলিত করে যায়গা করে নিচ্ছে বিদেশি অপসংস্কৃতি।
আমাদের আজ দরকার হাজার বছরের ইতিহাস কে সমোন্নত রেখে পুনরায় এসব সংস্কৃতিকে নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার। ছোটবেলা থেকেই নৈতিকতার শিক্ষা তরুন প্রজন্মকে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। নিজে বাঙালি সংস্কৃতি বুকে ধারণ করে অপরকে উৎসাহিত করতে হবে। তবেই অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে পারে আমাদের তরুন প্রজন্ম। এগিয়ে যাবে সবাই এক বিশুদ্ধ বাঙালি চিত্তকে ধারণ করে।