বিয়ের আশ্বাসে শারীরিক সম্পর্ক কি ধর্ষণ?
ইদানিংকালে বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার প্রাদুর্ভাব মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়েছে। কিন্তু, বিয়ের আশ্বাসে শারীরিক সম্পর্ককে আদৌ ধর্ষণ বলা যায়? এটা বুঝতে হলে, প্রথমেই কিছু আইনের আলোচনা করতে হয়।
(১)বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৪৯৩ ধারায় যা বলা হয়েছে, তা সহজভাবে বললে দাঁড়ায়- কোন পুরুষ যদি কোন নারীকে বিয়ের আশ্বাস প্রদান করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে তাকে প্রতারণামূলক শারীরিক সম্পর্ক বলে। এমন অপরাধের ক্ষেত্রে ঐ পুরুষের সর্বোচ্চ দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে উক্ত ধারায়।(২) দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে বিবাহিত নারীর সাথে যদি তার স্বামীর সমর্থন ব্যতীত ধর্ষণ নয় এমন শারীরিক সম্পর্ক করা হয়, তবে সম্পর্কস্থাপনকারী পুরুষ ব্যাভিচারের অপরাধে দন্ডিত হবেন এবং সর্বোচ্চ সাতবছর পর্যন্ত কারাদন্ড ভোগ করতে পারেন। এ ধারায় আরো বলা হয়েছে, এই অবৈধ সহবাস যাকে আইনের ভাষায় ব্যাভিচার বলা হচ্ছে, তা নারী-পুরুষ যৌথভাবে করলেও, নারীকে দুষ্কর্মের সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা যাবেনা। এ ধারায় এভাবেই নারীকে দায়মুক্ত করা হয়েছ।(৩) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এর ৯ ধারায় বলা হচ্ছে, যদি কোন পুরুষ ষোল বছরের বেশী বয়স্কা কোন নারীকে ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতি আদায় করে যৌন সঙ্গম করে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ, প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতি আদায়, সেটা হতে পারে বিয়ের আশ্বাস প্রদানের মাধ্যমে।
আইনগুলো দেখলে সহজেই বোঝা যায়, আইনগুলো মূলতঃ বহু অতীতে সমাজের অশিক্ষিত, দরিদ্র, সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিলো। বাংলাদেশের নারীসমাজকে সামগ্রিকভাবে পশ্চাৎপদ বিবেচনা করে সকল নারীর জন্য এ আইনগুলো সমানভাবে প্রয়োগযোগ্য হচ্ছে, যার সুযোগ নিয়ে পুরুষকে হেনস্তা করছেন নারীরা। শিক্ষিত-সচেতন নারী যারা দেশগঠন ও দেশ পরিচালনায় পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধমিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, তারা পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়ে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হবে, এমনটা হওয়া অসম্ভবই বটে। কারণ, তারা জ্ঞান বু্দ্ধি বিবেচনায় কোন অংশে পুরুষের চেয়ে কম নয়। ইতিমধ্যে ভারতের মুম্বাই হাইকোর্ট ২০১৬ সালে এক আদেশে বলেন, “প্রাপ্তবয়স্ক কোন শিক্ষিত নারী সম্মতির ভিত্তিতে শারীরির সম্পর্ক স্থাপনের পর ধর্ষণের অভিযোগ করতে পারেন না।”
সার্বিকভাবে দেখা যায়, দন্ডবিধির ৪৯৩ ধারায় প্রতারণামূলক সহবাসের অপরাধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, ঐ একই প্রকৃতির অপরাধকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণ বলে গণ্য করা হচ্ছে। তাই পুরুষকে হয়রানীর ক্ষেত্রে নারীরা অপেক্ষাকৃত নতুন এ আইনে মামলা দায়ের করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। কিন্তু, এ আইনে যে প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতিগ্রহণ পূর্বক সহবাসের কথা বলা হচ্ছে, তা কি আদৌ প্রতারণামূলক ভাবে হয়েছিলো কিনা, এটা বিবেচ্য বিষয়। সহবাসের সম্মতি যদি প্রতারণার মাধ্যমে গ্রহণ করা না হয়, তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবেনা।
একজন পুরুষ ও নারী যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছে, তখন সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে যেকোন আবেগঘন সময়ে তারা শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে কোন বিয়ের সম্মতি হয়েছিলো, কিনা তারা তা ভাবছেনা। তারা তাদের আবেগ ও শারীরিক চাহিদাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আবার, দীর্ঘকাল বিয়ের সম্মতিসহ প্রেমের সম্পর্ক চলাকালীন বহুবার শারীরীক সম্পর্ক হওয়ার পরে একপর্যায়ে ঐ নারী তার পরিবার, সমাজ বা অন্যকোনঅজুহাতে অনেকসময়ই প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে চলে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে, ঐ নারী বিয়ের আশ্বাস প্রদান করে ঐ পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর প্রতারণা করছেন। আইনের সুস্পষ্ট বিধানের অভাবে, এই প্রতারক নারীরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নারী যখন কোন পুরুষের সাথে সহবাসের পর প্রতারণা করছেন , তা ঐ পুরুষকে সামাজিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অথচ পুরুষ সমাজ এর কোন প্রতিকার পাচ্ছেনা। প্রেমের যেকোন পর্যায়ে কোন নারী যেমন কোন বিশেষ কারণে সম্পর্ক ভেঙে চলে যেতে পারছেন, পুরুষেরও তেমনটা পারা উচিৎ। অন্যথায়, আইনের চোখে সাম্য- ভুলুণ্ঠিত হবে। প্রেমের সম্পর্ক চলাকালীন যৌথ সম্মতিতে তাদের মধ্যে কোন শারীরিক সম্পর্ক আইন দ্বারা বিচার্য্য হওয়া উচিৎ নয়। কেননা, প্রেম আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য কোন চুক্তি নয়, কোন পক্ষ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে আদালতে আইন দ্বারা তার প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়।
আবার, অতি আধুনিককালে প্রেমের চেয়েও আধুনিক “শুধুই বন্ধুত্ব” বা ইংরেজীতে “জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ” সম্পর্ক প্রচলিত আছে এ সমাজেই। এ ধরণের সম্পর্কে নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রেম বা বিয়ের কোন সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকেনা কিন্তু, তারা নিজেদের শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য অনেকসময় একে অপরের সাথে অবাধ যৌন সম্পর্কে মিলিত হচ্ছে। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এ ধরণের সম্পর্ক স্থাপনের পর নারী যদি পুরুষের নামে অবৈধ সহবাস বা ধর্ষণের অভিযোগ করে, তা অবশ্যই ষড়যন্ত্রমূলক ও দূরভিসন্ধিমূলক
কাজেই, পুরুষকে বিপদে ফেলার জন্য কোন নারী যদি এমন কোন মামলা দায়ের করে তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, প্রতারণামূলক ভাবে তার সম্মতি গ্রহণ করা হয়েছিলো কিংবা বিয়ের আশ্বাস প্রদান করা হয়েছিলো। অতীতে সাধারণতঃ নারীরা বিয়ে ব্যতীত অবৈধ সহবাসকে ঘৃণিত কাজ মনে করতো, তাই বিয়ের আশ্বাস ব্যতীত তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হতো না। কিন্তু, আধুনিককালে নারীরা এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ককে সাদরে গ্রহণ করেছে। এমন অনেক সংঘবদ্ধ চক্র ইদানিংকালে সৃষ্টি হয়েছে, যারা পারিবারিকভাবে এটাকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা মামলা করার জন্য নারীদের দ্বারা টার্গেট করে কোন পুরুষকে প্রেমের ফাঁদে ফাঁসিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। অতঃপর মামলার চাপে ফেলে ঐ পুরুষকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
তাই, এমন মামলার বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকগণের অধিক সতর্কতা কাম্য। আইন অন্ধ হতে পারে, বিচারক অন্ধ নন। তাই, প্রতারক নারীদের দ্বারা এই কালাকানুনের অপপ্রয়োগের চেষ্টার ব্যাপারে পুরুষ সমাজের বিশেষ ভীত হওয়ার কারণ নেই। আমরা আশা করি, সেই দিন খুব দূরে নয়, যেদিন আইনের সংশোধনের মাধ্যমে এই অসঙ্গতি দূর করা হবে এবং অসৎ উদ্দ্যেশ্যে সঙ্ঘবদ্ধ নারীচক্রের উৎপাত থেকে বাঁচতে পুরুষের রক্ষাকবচ সৃষ্টি করা হবে। ঘটনার প্রেক্ষিতে অপরাধী সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক, তার আইনের আশ্রয়লাভের সুযোগ অবশ্যই থাকা উচিৎ।
মুহাঃ ইজাজ আল ওয়াসীশিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।