জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন গাছেরও প্রাণ আছে
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর কথা জানা যায়, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের কাছে জে. সি. বোস নামে পরিচিত। তিনি তার সময়ে বাঙালী বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান চর্চায় ছিলেন অগ্রগণ্য। বিজ্ঞানে তার অবদানের মধ্যে এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে জৈবপদার্থবিদ্যা বা বায়োফিজিক্স। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
মানব জীবনের ন্যায় উদ্ভিদেরও যে জীবন আছে, আছে অনুভূতি শক্তি তা এই জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুই আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তার এ অবদান বিশ্বদরবারে সে কালে ঝড় উঠেছিল। তারই আবিষ্কৃত এসকোনোগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে উদ্ভিদের যে জীবন আছে তা তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন যে উদ্ভিদের উপর বিভিন্ন প্রকার বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে ইলেক্ট্রন প্রবাহের ঘটনা ঘটতে পারে। একে এক সময় রাসায়নিক ক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হত। তিনি এই ধারণাকে পরবর্তীকালে পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি উদ্ভিদের টিস্যুর উপর মাইক্রোওয়েভের প্রভাব এবং এর ফলে কোষ মেমব্রেনের বিভব পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেন। কোষ মেমব্রেনের বিভব বলতে বোঝায় কোষের অন্তঃত্বক ও বহিঃত্বকের ভেতর ঘটিত তড়িৎ বিভবের পার্থক্য (সাধারণত -৪০ মিলিভোল্ট থেকে -৮০ মিলিভোল্ট পর্যন্ত)।
১৯০১ সালে এই বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন অবস্থায় এবং বিভিন্ন সময়ে কোষ মেমব্রেন বিভবের পর্যবেক্ষণ করে অনুমিত করেন যে উদ্ভিদও প্রাণীর মতো বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে সাড়া দিতে সক্ষম, অর্থাৎ তাদের ভেতর কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তারা ব্যথা অনুভব করতে সক্ষম, আনন্দ অনুভব করতে সক্ষম, এমনকি স্নেহ অনুভব করতেও সক্ষম। তিনি আরও প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদের একটি সঠিক জীবন চক্র এবং প্রজনন তন্ত্র রয়েছে যা প্রাণীর অনুরূপ। তার এই গবেষণাপত্র তখন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে স্থান করে নিয়েছিল।
উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করতে পারে সেই কথা তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আর এই প্রমাণের জন্য নিজেই তৈরী করেছিলেন ক্রিস্কোগ্রাফ নামক বিশেষ যন্ত্রের। এই যন্ত্রের বিশেষত্ব হলো বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে উদ্ভিদে উৎপন্ন উদ্দীপনাকে এটি রেকর্ড করতে সক্ষম। এটি উদ্ভিদ কোষকে এদের সাধারণ আকার থেকে প্রায় ১০ হাজার গুণ বিবর্ধিত করে দেখাতে সক্ষম ছিল যার দ্বারা সহজেই উদ্ভিদ কোষের উপর বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে সৃষ্ট স্পন্দন বা গতিকে প্রত্যক্ষ করা যেত। এর দ্বারাই তিনি দেখেন যে উদ্ভিদ কোষ ও প্রাণী কোষের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাদৃশ্য আছে।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়ীখাল গ্রামে। তিনি ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল ভগবান চন্দ্র বসু এবং মাতার নাম ছিল সুরুজ বালা সাহা।
তৎকালে জগদীশ চন্দ্র বসু পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তার নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে, তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে।
জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিস্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তার আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে একজন বিদ্বান হোন।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তার ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকূল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তার শিক্ষক ছিলেন।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ভারতে ফিরে আসেন। তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন, প্রথম মার্কুইস অব রিপন অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন।
১৮৮৬ সালে গবেষণা কাজের খরচের জন্য তাকে তার বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জের) শ্রীনগরের রাঢ়ীখাল গ্রামের পৈতৃক ভিটা বিক্রি করতে হয়। এরও কিছুদিন পর ১৮৯৭ সালে তিনি রাঢ়ীখালের আরও কিছু জমি বিক্রি করেন। এ সময় তিনি কলকাতার ১৩০ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটে বসবাস করতেন। অবশেষে ১৯১১ সালে দিল্লিতে রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে বিজ্ঞানী জগদীশ বসুকে ব্রিটিশ সরকার সিআইই উপাধি প্রদান করে এবং তার অসাধারণ বিজ্ঞানকর্মের ফল হিসেবে ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯১৭ সালে ‘নাইট’ (স্যার) উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৯২১-১৯২২ সালে দার্জিলিং শহরে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন। ওই সময়ে তিনি সালোক-সংশ্লেষণ কর্মধারার ওপর নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক গবেষণা করেন। এ বিজ্ঞানী ১৯৩৭ সালে ইহলোক গমন করেন। তার জীবদ্দশায় ১৯২১ সালে সেখানে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন ও কলেজের জন্য এবং সুরুজ বালা সাহা নামক স্কুলের জন্য তিনি বিশাল সম্পত্তি দান করেন।