আত্মহত্যা ও আমাদের সচেতনতা
আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোন ব্যাক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবণ বিসর্জন দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধাণ কারণ। প্রতিবছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন।
স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতিলাখে ৬ থেকে ১০ জন। অল্পবয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই প্রবনতা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ডাটা নেই, তবে বাংলাদেশে বেশির ভাগ আত্মহত্যার কারণগুলো খুব স্পষ্ট এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই একই ধাঁচের। মানসিক রোগ, মাদকাসক্তি, প্রেমে ব্যর্থতা, শারীরিক মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষায় ফেল, সহায় সম্পত্তি হারিয়ে ফেলা, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়া, অপমানিত, অপদস্থ হওয়া, ধর্ষিত হওয়া ইত্যাদি কয়েকটি কারনই প্রধান। অনেককে দারিদ্রতার কারনেও আত্মহত্যা করতে দেখা যায়।
যেহেতু আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা ঘটনা ঘটে নিজ গৃহে, কীটনাশক পানে অথবা গলায় দড়ি পেঁচিয়ে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে ঘরের সবাইকে আগে সাবধান ও সচেতন হতে হবে। জানতে হবে আত্মহত্যা কী, কারা করতে পারে। কারা ঝুঁকিতে আছেন।
অনেকে বলতে পারেন আত্মহত্যা কে বা কারা করবে, করবে না সেটা আমরা কী করে বুঝবো বা আদৌ কি বিষয়টা আগে থেকে টের পাওয়া যায়? এর পরিষ্কার উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’।
আত্মহত্যা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকলেই তবেই তা সম্ভব।
আত্মহত্যাকারীদের আত্মহত্যার ব্যাখ্যাঃ
বিশ্বের সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্টরা আত্মহত্যা নিয়ে অনুসন্ধান করতে আত্মহত্যাকারীদের বেশ কিছু ‘সুসাইডাল নোট’ বা আত্মহত্যাকারীর স্বহস্তে লিখে যাওয়া কিছু ‘চিরকুট’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। সবক্ষেত্রেই চিরকুটগুলোর সারমর্ম মোটামুটি এক। তা হলো- আত্মহত্যাকারী নিজেকে এখন সমাজ ও পরিবারের বোঝা মনে করছে বা সে তীব্র যন্ত্রণায় দিননিপাত করছে যা থেকে মুক্তি নেই, অথবা তার জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনায় এখন তার কাছে মনে হচ্ছে মৃত্যুই মুক্তি অথবা মৃত্যুই এখন একমাত্র সমাধান।
অনেক সময় দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভেবে বা নিজেকে অপাংক্তেয় ভেবে আত্মহননের পথ বেছে নেন। ঘোরতর মানসিক রোগীর কথা একটু ভিন্ন। রোগ হিসেবে বলতে গেলে বলতে হয়, আত্মহত্যার প্রধান কারণ হলো ডিপ্রেশন।
প্রতি তিনজন ডিপ্রেশন রোগীর মধ্যে দুইজনকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়।
অনেকে মনে করেন সাময়িক কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আত্মহত্যা করে, বিষয়টি আসলে ঠিক সে রকম না। তাহলে তো পৃথিবীর সবাই আত্মহত্যা করতো। মূলত আত্মহত্যাকারী নিজেকে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হয় যে তার বেঁচে থাকার আদৌ কোন মানে আছে। এটি তার থিংকিং প্রসেসের ভুল।
আত্মহত্যার লক্ষণ:
প্রায় সবক্ষেত্রেই আত্মহত্যাকারীর আত্মহত্যা করার পূর্বে তার মধ্যে বেশ কিছু শারীরিক ও আচার আচরণের পরিবর্তন দেখা যা দেখে খুব সহজেই বুঝা যায় প্রিয় মানুষ টি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। পরিবর্তন গুলো অনেকটা এরকম-
১) তার আচার-আচরণে ঘুম খাবার দাবারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়।
২)বন্ধু বান্ধব সামাজিক কাজকর্ম সব কিছু থেকে সে গুটিয়ে নেয়া শুরু করে।
৩)অতীতে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে সে আত্মহত্যার কথা বললে বা চেষ্টা করে।
৪)পড়াশোনা অফিস আদালত এসব নিত্যদিনের ক্রিয়া কলাপ থেকে গুটিয়ে নেয়।
৫) কোন কিছুর ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যেমন উইল করা, রিজাইন দেয়া, ইত্যাদি করে
৬) অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিপজ্জনক ঝুঁকি নেয়, যেমন ঝুঁকি পূর্ন ড্রাইভিং, অবাদে যৌন সম্পর্ক করা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন কারা বা মাদক সেবন করা।
৭) চরম কাঙ্ক্ষিত বিষয়, ব্যক্তিগত ভালোলাগার বা ভালোবাসার কোন বিষয়, বা জীবনের কাংখিত কোন গোল এর প্রতি হঠাৎ করেই অনাগ্রহ দেখায়।
৮) সারাক্ষণ মৃত্যুর কথা বলা, চিন্তা করা, অন্যকে প্রলুব্ধ করা, এলকোহল গাঁজা ইয়াবা ইত্যাদির ব্যবহার মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়া।
৯) বিষন্ন মনমরা হয়ে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়া ইত্যাদি।
সামগ্রিকভাবে আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য পরিবার এবং সমাজকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলছেন, এক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে, তবে পরিবারকেও নিজেদের আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
তিনি কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন:
- পরিবারের ছোটদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বাড়াতে হবে, তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে
- সন্তানদের খেলাধুলা করা এবং সামাজিক মেলামেশা করার সুযোগ বাড়িয়ে দিতে হবে
- সন্তানকে চাপ মোকাবেলা করতে শেখাতে হবে, পড়াশোনা বা খেলাধুলা নিয়ে সন্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ না করা
- ব্যর্থতা মেনে নেয়া নিজেরাও শিখতে হবে, বাচ্চাকেও শেখাতে হবে। ব্যর্থতা জীবনের অংশ এটা বুঝতে হবে
- তিরস্কার করা বা তাদের মর্যাদাহানিকর কিছু না বলা, মনে আঘাত দিয়ে বা সবসময় সমালোচনা না করা, সমবয়সী অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করা
- আত্মীয়, বন্ধু এবং আশেপাশের পরিবারসমূহকেও এ বিষয়ে সচেতন করা।