আন্তর্জাতিক খবর

মডার্না ও ফাইজার/ বায়োএনটেকের পার্থক্যগুলো কী

আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে জেনে থাকবেন, আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এক সপ্তাহের ব্যবধানে দু-দুটো ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি গড়ার লক্ষ্যে ইমারজেন্সি ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে। দুটোই হচ্ছে এমআরএনএ ভ্যাকসিন। একটি ভ্যাকসিনের উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জার্মানির বায়োএনটেক এবং তার পার্টনার আমেরিকার জায়ান্ট ফার্মাসিউটিক্যাল ফাইজার। এই ভ্যাকসিন ১১ ডিসেম্বরর ‘২০ ইমারজেন্সি ব্যবহারের জন্য এফডিএর অনুমতি পায়। দ্বিতীয় এমআরএনএ ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানের নাম মডার্না, যার লোকেশন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন/ক্যামব্রিজ শহরে। মডার্নার ভ্যাকসিনটি অনুমোদন পায় ১৮ ডিসেম্বর।

বায়োনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে শতকরা ৯৫ ভাগ এফিকেসি (কার্যকারিতা) এবং মডার্নার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যা প্রায় সমান, অর্থাত্ ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ এফিকেসি ক্লিনিক্যাল স্টাডি থেকে উঠে এসেছে। ফাইজার/ বায়োএনটেকের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল স্টাডি ফেজ-৩-এ ৪৩ হাজার পার্টিসিপেন্ট ভলান্টিয়ার হিসাবে অংশ নেয়। অন্যদিকে, মডার্নার ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে ৩০ হাজার ভলান্টিয়ার অংশ নেয়। একই টেকনোলজি (এমআরএনএ) ব্যবহার করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন দুটির আবিষ্কার পৃথিবীর বুকে আশার আলো জাগিয়ে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে এমআরএনএ টেকনোলজি ব্যবহার করে কখনোই কোনো ডিজিজের বিরুদ্ধে কোনো মেডিসিন বা ভ্যাকসিন পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি।

ভ্যাকসিন দুটি এক হলেও (এমআরএনএ) এগুলোর আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন বিধায় ভ্যাকসিন দুটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু তারতম্য রয়েছে। যেমন কোন বয়স থেকে ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে, ভ্যাকসিনদ্বয়ের ডোজের মধ্যে ব্যবধানই বা কতটুকু, কীভাবে এবং কত তাপমাত্রায় ভ্যাকসিনগুলো স্টোরেজ করা যেতে পারে, কয়টি ডোজ নিতে হবে এবং দুই ডোজের মধ্যে সময়ের ব্যবধানই বা কতটুকু এবং একেকটি ভায়ালে কয়টি করে ভ্যাকসিন ডোজ থাকবে, সেসব নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। এবার চলুন তাহলে ভ্যাকসিনদ্বয়ের ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্যের ওপর একটু চোখ রাখা যাক।

১. ভ্যাকসিন ইনকুলেশনের জন্য যাদের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর বা তার নিচে, মডার্নার ভ্যাকসিন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মডার্নার ভ্যাকসিন নিতে হলে ন্যূনতম ১৮ বছর বা তার ওপরে বয়স হতে হবে। অন্যদিকে বায়োএনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ১৬ বছর বা তার ওপরের যে কোনো বয়সি মানুষই নিতে পারবে। বয়সের এই ডিফারেন্সের মূল কারণ হচ্ছে, এই কোম্পানিগুলো যখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছিল, তখন এই বয়সের মানুষগুলোকে ট্রায়ালের জন্য তারা নির্ধারণ করেছিল। তবে এটা জানা থাকা ভালো যে, মডার্না কম বয়সের ছেলেমেয়ে, অর্থাত্ ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে।

২. ভ্যাকসিনের ডোজ এবং দুই ডোজের মধ্যে সময়ের ব্যবধান

সার্স-কভ-২ বা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে শরীরের ইমিউন বুস্টের জন্য উভয় ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই দুটি করে ডোজের প্রয়োজন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতটুকু, অর্থাত্ কত দিন অপেক্ষার পালা তা নির্ধারণ করা হবে কোন কোম্পানির ভ্যাকসিন শরীরে পুশ করা হচ্ছে (ফাইজার, নাকি মডার্না) তার ওপর ভিত্তি করে। যেমন বায়োএনটেক/ফাইজারের এমআরএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ নেওয়ার পর আপনাকে একুশ দিন (২১) অপেক্ষা করতে হবে। তারপর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। অন্যদিকে, মডার্নার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষার পালা ২১ দিন নয়, আরো সাত দিন বেশি, অর্থাত্ ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে।

যে স্থানগুলো থেকে ভ্যাকসিন শরীরে পুশ করা হবে, যেমন ক্লিনিক বা হাসপাতাল বা হেলথ কেয়ার লোকেশন বা ফার্মেসিগুলো, তাদের দায়িত্বের মধ্যে থাকবে আপনাকে দ্বিতীয় ডোজের সময় বলে দেওয়া এবং সে অনুযায়ী ২১ বা ২৮ দিন পর আপনাকে দ্বিতীয় ডোজের জন্য ঐ স্থানগুলোতে আবার ফিরে আসতে হবে।

৩. স্টোরেজ কন্ডিশন

এমআরএনএ ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য সঠিক স্টোরেজ কন্ডিশনকে বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। কারণ, এমআরএনএ হচ্ছে মেসেঞ্জার রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড এবং এর ধর্মই হচ্ছে এটি দ্রুত ডিগ্রেড করে (সংবেদনশীল, যা সহজে ভেঙে যায়), যদি প্রোপার কন্ডিশনে সংরক্ষণ করা না যায়। ক্লিনিক্যাল স্টাডি অনুযায়ী, মডার্নার ভ্যাকসিনকে স্টোর করার জন্য যে তাপমাত্রা রিকোমেন্ড করা হয়েছে, তা হচ্ছে -৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে, বায়োএনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিন আরো নিম্ন তাপমাত্রায় স্টোর করতে হবে। তা হচ্ছে -৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

দুই ভ্যাকসিনের স্টোরেজের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার এই বিস্তর ব্যবধান কতটা জটিলতা তৈরি করতে পারে, তা একটু ভেবে দেখা দরকার। সচরাচর যে ফ্রিজগুলো আমরা খাদ্য স্টোরেজের জন্য ব্যবহার করে থাকি, তার তাপমাত্রা থাকে -৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। হাসপাতাল এবং ফার্মেসিগুলোতেও এই ফ্রিজগুলো বিশেষ বিশেষ মেডিসিন স্টোরেজের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মডার্নার ভ্যাকসিন স্টোরেজের ক্ষেত্রে ফার্মেসি বা হাসপাতালগুলোকে বড় ধরনের কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না। কিন্তু -৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বায়োএনটেক/ফাইজারের ভ্যাকসিন স্টোরেজের জন্য ফার্মেসি বা হাসপাতালগুলোকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো অধিক অর্থের বিনিময়ে স্টোরেজের এই জটিলতা ওভারকাম করতে পারলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ফাইজারের ভ্যাকসিন স্টোরেজ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তদুপরি এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ট্রান্সপোর্টের ক্ষেত্রেও (শিপমেন্ট বা সাপ্লাই চেইন) একই তাপমাত্রা মেনটেইন করতে হবে।

উপরন্তু, ভ্যাকসিন দেওয়ার সাইটগুলোতে ফাইজারের ভ্যাকসিন ডিপ ফ্রিজ (-৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থেকে বের করার পর থ (thaw) করে মাত্র পাঁচ দিন পর্যন্ত নর্মাল রেফ্রিজারেটরে স্টোর করে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মডার্নার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে থ (thaw) করার পর নর্মাল রেফ্রিজারেটরে সর্বাধিক ৩০ দিন পর্যন্ত রাখা যাবে। এমনকি কক্ষ তাপমাত্রায় সর্বাধিক ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত রেখেও তা ব্যবহার করা যাবে। অর্থাত্ তাপমাত্রার ঝুঁকি বিবেচনায় নিলে মডার্নার ভ্যাকসিনটি ফাইজারের ভ্যাকসিনের চেয়ে সহজেই স্টোরেজ করে তা শরীরে ইনকুলেশন করা সম্ভব।

৪. প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের পরিমাণ এবং ন্যূনতম কত ডোজ অর্ডার করা যাবে

মডার্নার ক্লিনিক্যাল স্টাডি অনুযায়ী প্রতি ডোজের মধ্যে ১০০ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ এমআরএনএ ভ্যাকসিন থাকবে। অন্যদিকে, বায়োএনটেক/ফাইজারের ক্ষেত্রে প্রতি ডোজ ৩০ মাইক্রোগ্রাম এমআরএনএ ভ্যাকসিন থাকবে। দুই ফার্মার প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের পরিমাণের এই তারতম্য মাথায় নিলে দেখা যাচ্ছে যে, সমানসংখ্যক ডোজ সরবরাহের জন্য মডার্নাকে প্রায় সাড়ে তিন গুণ অধিক পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে হবে ফাইজারের চেয়ে (১০০ মাইক্রোগ্রাম বনাম ৩০ মাইক্রোগ্রাম)। মডার্নাকে প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বাড়াতেই হবে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তাছাড়া আমেরিকার ভ্যাকসিন ইনকুলেশনের সাইটগুলোতে ন্যূনতম কত ডোজ ভ্যাকসিন অর্ডার করা যাবে? ফাইজারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম অর্ডারের পরিমাণ হবে ৯৭৫ ডোজ এবং মডার্নার ক্ষেত্রে ১০০ ডোজ।

৫. প্রতি ভায়ালে কত ডোজ ভ্যাকসিন থাকবে

জীবন রক্ষাকারী এই ভ্যাকসিনের ডোজ কেউ নষ্ট করতে চাইবে না। একেকটি ডোজই যেন একেকটি জীবনের সমান। যেহেতু কোল্ড ও আলট্রা কোল্ড তাপমাত্রা মেনটেইন করে অনেকগুলো ভ্যাকসিন ডোজ একসঙ্গে স্টোরেজ করাটা ব্যয়বহুল ব্যাপার, তাই ভ্যাকসিন পুশ করার সাইটগুলোতে (বিশেষ করে রুরাল এরিয়ায়) একেকটি ভায়ালের মধ্যে কয়টি করে ভ্যাকসিন ডোজ থাকবে তা আগে থেকেই জানাটা জরুরি। তাতে করে ডোজ অপচয় বা নষ্ট এড়ানো সম্ভব। বায়োএনটেক/ফাইজার যে ভ্যাকসিনগুলো সরবরাহ করছে, তাতে প্রতি ভায়ালে পাঁচ ডোজ করে ভ্যাকসিন থাকছে। মডার্নার ভ্যাকসিনে প্রতি ভায়ালে দ্বিগুণ, অর্থাত্ ১০ ডোজ ভ্যাকসিন থাকবে।

ফাইজারের ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে কয়েক মিলিয়ন মানুষের দেহে পুশ করা হয়েছে। এ সপ্তাহ থেকে মডার্নার ভ্যাকসিনটিও দেওয়া শুরু হচ্ছে। প্রতিদিন আমেরিকার মাটি থেকে ঘাতক কোভিড-১৯-এর আক্রমণে আড়াই থেকে তিন এমনকি সাড়ে তিন হাজার জীবন ঝরে যাচ্ছে। নতুন টেকনোলজির এই এমআরএনএ ভ্যাকসিন দুটি তাই আশা জাগিয়েছে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে শরীরের হার্ড ইমিউন বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার।

লেখক : বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button