ছুরিকাঘাতে নিহত বিশু মিয়ার বুকপকেটের স্বপ্ন: মাসুদুর রহমান বাপ্পি

বগুড়া আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাসে বিশু মিয়া (৩২) নামে এক সাবেক শিক্ষার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। রােববার আনুমানিক রাত ৯.০০ মিনিটে ক্যাম্পাসের বিজ্ঞান ভবনের পিছনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত বিশু শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের মৃত জাহিদুল ইসলামের ছেলে। তিনি আজিজুল হক কলেজে ২০১৬-১৭ বর্ষের একাউন্টিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন। বিশুর মৃত্যুর পর আইডিএলসি ফাইন্যান্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বগুড়া জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান বাপ্পি’র দেয়া হৃদয়স্পর্শী ফেসবুকের স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো –
“বিশু মিয়া একজন মানুষ ছিলেন। ছিলেন বললাম এই জন্যে যে, বিশু মিয়া আর এই পৃথিবীতে নেই। গতকাল রাত নয়টায় কিছু মানুষের হাতেই সে জীবন হারায়। না কোন জুয়ার টাকা কিংবা সম্পত্তি নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব না, বরং নিজের স্বপ্নকে বাঁচাতে গিয়েই জীবন হারায় বিশু। ছেলেটা আমার সাবেক সহকর্মী ছিলো। বয়স কতই হবে? ২৫-২৬ হয়তো। গত দুইবছর আগে আইডিএলসির এক নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমাদের অফিসে জয়েন করে।
প্রথমদিন অফিসে ওকে দেখেই আমি চমকে উঠি। একি অবস্থা!! জরাজীর্ণ ক্যাজুয়াল শার্ট, মলিন প্যান্ট আর বহু ব্যবহারে হতশ্রী একজোড়া স্যান্ডেল। নভেম্বর ডিসেম্বরের শীত উপেক্ষা করে ছেলেটা রীতিমতো কাপছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম, “বিশু আমাদের ড্রেস কোড আছে। আমাদের ড্রেস কোড অনুযায়ী আপনাকে পোষাক পড়তে হবে। এগুলো পড়ে অফিসে আসতে পারবেন না।” আমাকে খুব ছোট্ট করে উত্তর দিল, “জ্বী বস। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিন।” আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের কাজে চলে গেলাম। কয়েকদিন পর দেখলাম নতুন শার্ট, নতুন জুতা আর পুরোনো একটা ব্লেজার গায়ে বিশু। আমি ওরে ইয়ার্কি মেরে বললাম, ” এইতো জাতে উঠছেন গো, দারুণ লাগছে। ছেলেটা আমার প্রতুত্তরে আমাকে হাসি উপহার দিয়েছিলো। পরে জেনেছিলাম ওরা শার্ট, জুতা, ব্লেজারের ব্যবস্থা আমার আরেক সহকর্মী করে দিয়েছিলেন। আমার কৌতুহল হলো, শেষে ওই সহকর্মীকে গিয়ে ধরলাম “ঘটনা কি ভাই, কন তো?” যা শুনলাম তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
খুব ছোটবেলায় বিশুর বাবা মারা যান। ছোট দুইবোন আর মাকে নিয়ে সংসার। পরিবারের খুবই খারাপ অবস্থা। মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় আর বিশুর নুন-পান্তা দুটোই খোঁজ করতে হতো। চালের ফুটো টিন আর শতচ্ছিন্ন বেড়ার বাড়িতে বিশুর পরিবারকে সংগ্রাম করে বাঁচতে হতো। এই অভাব অনটনের মাঝেই বগুড়ায় মেসে থেকে বিশু মেসে থেকে লেখাপড়া করতো। বোনকেও অনার্স ভর্তি করে দেয়, অনেক কষ্ট করে কলেজের মহিলা হোস্টেলে বোনের থাকার ব্যবস্থা করায়। চার-পাঁচ মাস আগে বিশু চাকুরিটা ছেড়ে দেয়। বিশুর চোখে তখন সরকারি চাকুরির হাতছানি। এত ভালো প্রস্তুতি আর এতবড় স্বপ্নের সাথে বেসরকারি মার্কেটিং চাকুরি করে আবার রাতে পড়তে বসা খুব কঠিন। আমার এক সহকর্মীকে ফোনেও বলেছিলো, এইবারের প্রস্তুতিটা অনেক ভালো, দোয়া কইরো।
বোনের হোস্টেল খরচ আর নিজের মেস খরচের জন্যে বিশুর কিছু টাকার দরকার হয়, গ্রামে গিয়ে বিশু কষ্ট করে কিছু টাকা নিয়ে আসে গতকাল। ঝড় থামলে বোনকে ৪০০০/- টাকা নিয়ে নিজের মেসে ফিরছিলো। নিজের পকেটে হয়তো ওই ৩-৪ হাজার টাকায় ছিলো। ঝড়ের তান্ডবে কারেন্ট ছিলো না সারা শহর। এই সুযোগটাই নেয় হয়ত ছিনতাইকারীরা। বিশুর পথরোধ করে (দৃশ্যত ৩০০০-৪০০০ টাকা, কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশুর পকেটে তখন একটি পরিবারের স্বপ্ন) সবকিছু কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু বিশু বাধা দেয়, মিনতি করে, দয়া ভিক্ষা চায়। পাষণ্ডদের হৃদয় গলে নি তাতে। টাকা ছিনিয়ে নেয়ার পর, এতক্ষণের বিশুর দেয়া বিরক্তির দাম মেটায় উপর্যুপরি চাকুর আঘাতে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া বিশুর শরীরের সাথে লুটিয়ে পড়ে একটা মায়ের সারাজীবনের স্বপ্ন, একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, পতাকা আর স্বাধীনতা।(কাল্পনিক)
আমাদের বিশু সবাইকে মুগ্ধ করার মত চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে আসে নি। বরং এসেছিলো সবাইকে জয় করার মত একটা হৃদয় নিয়ে। গাঢ় শ্যামলা, দীর্ঘদেহী, কথায় আঞ্চলিকতা, সারল্য মেশানো হাসি আর অপূর্ব চোখদুটো দেখলেই আমার জসীমউদ্দিনের রুপাইয়ের কথা মনে হতো। আমার জীবনে দেখা ৫ জন সরল মানুষের মধ্যে বিশু একজন। এতকথা লিখলাম বিশু হত্যার বিচারের জন্যে নয়। মর্গে নিথর পড়ে থাকা বিশু হত্যার বিচার আমি চাই না। বিচারের বাণী আপাতত নিভৃতেই কাদুক। কিন্তু বিশুর পরিবারের কি হবে? কে নিবে তাদের মুখে দুবেলা ভাত জোটানোর দায়িত্ব? কে তার বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগাবে?
আরও পড়ুন – বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ছুরিকাঘাতে এক যুবক নিহত