❀ শিক্ষায় নবজাগরণ চাই!
বলা হয়ে থাকে, মানুষের দোলনা থেকে কবর পুরোটাই শিক্ষা। কবির কবিতার পাতায় ধরা দেয়,
“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর
সবার আমি ছাত্র
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।”
সেজন্যই হয়তো মৃত্যুঘণ্টা বাজাবার জন্য বাদকের হাত উপরে তোলার মুহূর্তেও আলবার্ট আইনস্টাইনের সময় কেটেছে ইউনিফিকেশনের চেষ্টায়।অবসর নেয়ার একটু আগেও হয়তো একই কারণে অনেক খেলোয়াড় বলে ফেলেন, এখান থেকে থাকবে শিক্ষা, যদি হয় পরবর্তীর উন্নয়ন। সারাজীবন সাধনা করে বুড়ো বয়সেও শেখার শেষ হলো না পিটার হিগস কিংবা আনিসুল হকদের।
একবিংশ শতাব্দীর প্রধানতম সম্পদ যদি হয় জ্ঞান, তার অন্যতম এবং আবশ্যিক হাতিয়ার সুশিক্ষা। ব্যস্ততার এই যুগে মানুষের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত শহরের শিক্ষা বলতে বোঝানো হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই। কারণ এখানে এসেই ব্যাক্তি অর্জন করে সুষ্ঠু আচরণিক পরিবর্তন, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, ধৈর্য। জ্ঞান বিকাশের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীর কাছে এই প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার উন্নয়ন পারে সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে৷ তাই নিজেদের স্বার্থেই প্রতিটি রাষ্ট্র সচেষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে। কারণ জ্ঞানের অবিস্যম্ভাবী বিপ্লবে পিছিয়ে পরতে রাজি নয় কেউ!
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে যখন করোনার বিষাক্ত ছোবলের ছায়া পরে, শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রয়োজনে বন্ধ করা হয় স্কুল-কলেজ। বন্ধ করে দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথায় জীবন যদি হয় নিচতলা, তাহলে শিক্ষা তার উপরের তলা। নিচতলাকে ছাপিয়ে উপরের তলায় উঠতে গেলে তা কখনোই সম্ভব না। জীবনই যদি সংকটে থাকে, তাকে সুন্দর করার চেষ্টা নিতান্ত অমূলক।
কিন্তু একথা কম সত্য নয় যে, জীবনে যদি সৌন্দর্য না থাকে, সে জীবন অনেকের কাছেই অকাম্য। আর সেজন্যই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার চেষ্টা ছিল কোনোভাবে যদি স্কুল কলেজ খুলে দেয়া যায়..। মার্চ ২০২১ পেরিয়েছে, কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠে নি।
হয়তো আবার একদিন স্কুল খুলবে, কলেজ খুলবে, ভার্সিটি খুলবে, আবারো শিক্ষার্থীদের হৈ হুল্লরে মাতবে বেঞ্চের আন্দোলন, জীবনের আনন্দ খুঁজে পাবেন বর্ষীয়ান এক শিক্ষক। কিন্তু, মাঝখানে যে ক্ষতি হলো, এর উত্তর আছে কি? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এক বছরে বাংলাদেশে ঝরে পরা শিক্ষার্থীদের হার দাঁড়াবে ২০ শতাংশের উপর! যদিও সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের দাবি, তাদের পরিচালিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এসাইনমেন্ট কার্যক্রমে ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে, যারা ঝরে পরতে যাচ্ছে না। এর মাঝে দেশে গত কয়েক বছরে বাল্যবিবাহের হারের নিম্নমুখী গতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ অনেক কর্মসংস্থান হারানো বাবা মার সন্তান এখন শিক্ষার্থী থেকে পেশাজীবিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। পড়ালেখার অধ্যায় শেষ করে এতোদিনে যে ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেছিল, তার স্বপ্ন আজ ধূলিসাৎ হবার পথে বয়সের ভারে। গত বিসিএস এ ভাইভা পর্যন্ত যাওয়া চাকরিপ্রার্থীদের অনেকের বয়স ৩০ হয়তো ছাড়তে যাচ্ছে শীঘ্রই!
দেশে গত ১৪-১৫ মাসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে একেবারেই বন্ধ ছিল, তা না। সামর্থ্যবানরা অনলাইন ক্লাসে চালিয়ে নিয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা চলছে। কিন্তু একটি বিশাল অংশ এর বাইরে ছিল। এবং অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতিতে যেটুকু দক্ষতা কিংবা নেটওয়ার্ক প্রয়োজন, তার প্রশ্ন রয়েই যায়। আবার আমাদের সব শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা না থাকায় তার অপব্যবহার এখন খুবই স্বাভাবিক। করোনা এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের করোনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালির সবচেয়ে ভালো অবস্থার মতো বা তার চেয়েও হয়তো ভালো। কিন্তু তাদের শিক্ষার্থীরা থেমে নেই। আমি জানি, বাংলাদেশ আর ইতালি এক নয়। এখানে অবকাঠামোগত দূর্বলতা রয়েছে, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। দিনশেষে, যতোই সমালোচনা হোক, বাংলাদেশ যা করতে পেরেছে, এতে অসন্তোষ নেই আমার।
তবে, এই অজুহাতে বেশিদিন টেকা সম্ভব না। প্রথম ধাক্কায় শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষালাভ করতেই হবে৷ সামনেই দেশের বাজেট ঘোষণা । এখানে শিক্ষার্থীদের অবকাঠামো উন্নয়নের অগ্রাধিকার থাকা একান্ত কাম্য। আমাদের অবকাঠামোগত দূর্বলতা দূর করতে শুধু উদ্দ্যোগ নেওয়া যথেষ্ট নয়, তার বাস্তবায়ন এবং তত্ত্বাবধায়ন জরুরি এবং আবশ্যক। আমাদের ছেলেমেয়েদের শুরু থেকেই প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। শুধু আইসিটি বই পড়ে নয়, নিজেদের ডিভাইসে নিজের পড়াশোনার কাজটুকু করতে শেখানো প্রয়োজন একদম প্রাক প্রাথমিক লেভেল থেকেই। কারণ, হঠাৎ করে প্রযুক্তির স্পর্শ পেলে অপব্যবহারের সুযোগ থাকে, কিন্তু সূচনা থেকেই তা সংযুক্ত থাকলে তার প্রয়োজনটুকুই উপভোগ করা সম্ভব।
স্কুল কলেজের বিল্ডিং ভিত্তিক পড়াশোনায় কিছুটা পরিবর্তন চাই। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের স্বার্থে তা বন্ধ করা অসম্ভব। নিয়মিত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কার্যক্রম চাই। ছোটখাটো ক্লাসটেস্ট ক্লাসের সময় নষ্ট না করে বাড়িতে বসে দেয়ার অভ্যাস করানো যায়৷ শিক্ষার্থীদের বই এর বোঝা কমিয়ে ই-বুক সময়ের দাবি। আগে যে পয়সা খরচ হতো পাব্লিকেশনের কাজে, সে টাকায় নাহয় ৩-৪ বছর স্থায়ী কোনো ডিভাইস দেয়া হোক। এসবের ফলে যা হবে, তা হলো দেশের শিক্ষায় বৈষম্য কিছুটা হলে হ্রাস পাবে। গ্রামে গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাচ্চারা পড়াশোনায় আইটিকে সরাসরি ব্যবহার করবে। দেশের অপারেটর গুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র গ্রামীণফোন যে পরিমাণ জরিমানা সরকারকে দিতে বাধ্য, সে টাকায় হয়তো অন্তত ৮-১০ উপজেলাকে ফ্রি ওয়াই-ফাই এর আওতাধীন করা সম্ভব। (বেশিও হতে পারে, ব্যাক্তিগত মত কম হওয়াই শ্রেয়) কম টাকায় ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক চলমান রাখতে হবে৷ নাহলে গ্রামকে শহর বানানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থতা বই কিছু না।
মোটকথা, শিক্ষায় একটা নতুন জাগরণ দেখা দরকার।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে অর্থ হয়তো লাগবে বেশি, কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় পূর্বের থেকে খুব বেশি না। আর শিক্ষায় ইনভেস্ট প্রোডাক্টিভ ইনভেস্ট সবসময়ই।