করোনা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য
করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ১৮ মার্চ ২০২০ থেকে সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষার্থীরা দূরে রয়েছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়ম থেকে।
ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯০টি দেশের ১.৫ বিলিয়ন শিক্ষার্থী এখন প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন ও বাড়িতে অবস্থান করছে। এর ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ঘরে থাকতে হচ্ছে। তারা এখন খেলার মাঠে বা বাইরে যেতে পারছে না। কোনো বন্ধু বা সহপাঠীর সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না। ক্ষেত্র ও অবস্থা বিবেচনায় শুধু ভার্চুয়াল যোগাযোগ চলমান রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চা, আড্ডা, হৈচৈ, খেলাধুলা করে আনন্দের সঙ্গেই শিক্ষার্থীদের সময় কাটত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সঙ্গে বাইরের কার্যক্রম থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঘরে থাকতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে, ইচ্ছা হলে বা সুযোগ থাকলেও একটু সময়ের জন্য ঘরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না।
মোট কথা, কোনো সংযোগই রাখা যাচ্ছে না। এখন একমাত্র ভরসা হচ্ছে টেলিফোন ও ইন্টারনেট, তা-ও ধীরে ধীরে তাদের মনের ওপর নির্ভরশীলতার প্রভাব দ্বারা বড় রকমের ক্ষতির অবস্থা বিদ্যমান। তবু মানুষের মূর্ত উপস্থিতি যখন না থাকে, তখন কত আর ভাববিনিময় করা যায়। ফলে ভাবের আদান-প্রদানও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শিক্ষার্থীদের কাছে বিনোদন, আনন্দ বলে কিছু নেই। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত হলে গণমাধ্যমের বদৌলতে সময় পার করে দেবে। যারা হতদরিদ্র, যোগাযোগের সমস্যায় গণমাধ্যম বা কোনো প্রাযুক্তিক সুযোগ-সুবিধা যাদের নেই, তারা এ সময়ে কী করবে? এ সংকটে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘকালীন ক্ষতির সম্ভাবনা বিবেচনায় অনলাইন পাঠদান শুরু হয়ে এখনো চলমান রয়েছে। যেটুকু জানা যায়, শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছে ও উপকৃত হচ্ছে; কিন্তু কত দিন সেটি অজানা, উপস্থিতি আর কত! অনেকটাই রেজিসট্যান্স হয়ে গেছে।
আমরা সবাই জানি, শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন শুধু পাঠদানের ওপর নির্ভর করে না। পরস্পর মিথস্ক্রিয়া বলে একটা কথা আছে। এখন এটাও হচ্ছে না। বাইরের আলোবাতাসে তারা দৌড়াদৗড়ি করছে না। ক্লান্ত হচ্ছে না। যা কিছু শিক্ষারই অংশ। গৌণ কাজগুলোই মূল শিক্ষাকে প্রণোদিত করে এবং রাষ্ট্র ও সমাজে দায়বদ্ধ হতে শেখায়। মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে নিজের প্রস্তুতিকে সহায়তা করে।
লক্ষণীয় বহির্জাগতিক নানা বিষয়ে কোনো না কোনো শিক্ষার্থীকে প্রায় প্রতিদিন নানা রকম দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়। যা কিছু মোকাবেলা করতে করতে তারা সমাজবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। ফলে আমরা যা প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন থেকে শিখি, এর চেয়ে বেশি শিখি বহির্জাগতিক বাস্তবতা ও প্রকৃতি থেকে। করোনা সমস্যার কারণে তারা এ জীবনবাস্তবতা ও প্রকৃতি থেকে এখন বিচ্ছিন্ন আর তা দীর্ঘ হচ্ছে বলেই সমস্যা।
পরিবার বা নিজের বাসস্থান সবার জন্য সুখকর না। এই সংখ্যা কম হলেও একেবারেই যে নেই এমন না। অনেক পরিবার আছে যারা নিজের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য বা মতামতের খেয়াল রাখেন না। মেয়েদের কিছুটা জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বা হলে থাকার কথা সে এখন শ্বশুরবাড়িতে নিজের সংসার সামলাতে ব্যস্ত। অনেক ছেলে আছে যারা পড়াশুনার পাশাপাশি নিজের হাত খরচের ব্যবস্থা করার জন্য টিউশন করাতো। এই করোনা পরিস্থিতিতে হল বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কারণে তাদের সেই সুযোগ বন্ধ যার ফলে তারা হতাশায় ভুগছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় নিজের হতাশা, একাকীত্ব নিজের বন্ধু বা বাবা-মার সাথে শেয়ার করতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৮ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে আগামী দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও আর ফেরা হবে না তাদের।
মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, প্রেমঘটিত টানাপড়েন, আর্থিক সংকট, বিষণ্নতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছে না। এ জন্য পরিবারের দায়িত্বশীল ভূমিকা, সচেতনতা ও সহনশীলতা বাড়াতে হবে। বিষণ্নতাগ্রস্ত ব্যক্তিকে একা না রাখা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলরসহ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং কোনো একটি অভাব পূরণ না হওয়া মানে জীবন শেষ নয়, এই উপলব্ধিসহ অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে আত্মহত্যাপ্রবণতা রোধ করা সম্ভব।
আমরা চাইনা এই করোনা মহামারীতে ঝরে পড়ুক আর কোন শিক্ষার্থী। একটি শিক্ষার্থী হারানো মানে দেশের একটি সম্পদ হারানো। অভিভাবকদের উচিত নিজের সন্তানের মানসিক স্বাস্থের খেয়াল রাখা নিয়মিত কথা বলা সে ভালো আছে কিনা জানার চেষ্টা করা। বন্ধু বা সহপাঠীদের উচিত নিজের বন্ধুর খবর রাখ, সে যদি হতাশায় ভোগে তাহলে তাকে সাহস এবং উৎসাহ দিয়ে হতাশা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করা অথবা তার বাবা-মার সাথে কথা বলে তাকে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া। একটি শিক্ষার্থী হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করলে সে দায় কিছুটা দেশেরও বটে৷ যতদ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক এটাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দাবি। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় রাখা এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাতে আর কোন তাজা প্রাণ অকালে ঝরে না পরে।
তাসনিয়া তাসনিম শ্রুতি
নব্যদীপ্তি_শুদ্ধ চিন্তায় তারুণ্য।