❀ সাধারণ শিক্ষাই হোক অসাধারণ!
একটা টাইমমেশিন দিয়ে ভবিষ্যৎ ভ্রমণ আদতে সম্ভব কি না- কে জানে? তবে রিলেটিভিটি কিংবা হায়ার ডাইমেনশনের জটিল সদুত্তরের অপেক্ষায় কি মানুষ চিন্তা ভুলে যাবে? না, মানুষ তার মনের চোখে দেখতেই থাকবে তার ভবিষ্যৎ। জানালার ফাঁকে বৃষ্টি দেখার ছলনায় অজান্তেই ওয়ার্ম হোলের সন্ধান পেতেই থাকবে সে। আচ্ছা! দেশ যদি ভবিষ্যৎ দেখতে পারত? হয়তো দেখত! কিন্তু আর যাই হোক, তার দেখাটা মানুষের মতো এতোটা সুমধুর নয়। সুমধুর শব্দটা হতে পারে অনেক সুন্দর, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই মিষ্টি কিছুর ফলাফল মিথ্যা৷ কারণ ঐ কল্পনার সামান্যতম ভাগই আমাদের ইউনিভার্সে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু দেশ তো মানুষের মতো লোভীও নয়, উচ্চাকাঙ্খীও নয়। সে একটা প্রাণহীন অস্তিত্ব। সে বর্তমানের তথ্য বিশ্লেষণ করেই একটা ফাংশন বের করে ফেলবে। মাঝে যদি বেশ কৌতুহল উদ্দীপক অচিন্তনীয় পর্যায়ের কিছু নাই হয়, ফলাফলের নিশ্চয়তা অনেক বেশি। হয়তো তার ডেরিভেটিভ শিক্ষার ফাংশন। নিঃসন্দেহে জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত বর্তমানের শিক্ষার উপর।
শিক্ষা অর্থ বই পড়া না, কলেজ পাশ করাও না। জ্ঞানী মানুষেরা বলে আচরণের পরিবর্তন শিক্ষা। আমার কাছে শিক্ষা হলো সমগ্র জীবনের পরিবর্তন। কারণ এই একটা বিষয়ের উপস্থিতি অনুপস্থিতি নির্ণয় করে তার জীবনের অস্তিত্বকে। সময়ের ধারায় এখন শিক্ষা গ্রহণের স্থান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদি একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটাতেই হয়, সবারই সমান উন্নয়ন চাই। তেমনি সবার জন্য সমান শিক্ষা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক রহস্যজনক। অনেকে অনভিজ্ঞের কাছে একটা থ্রিলারের মতো মনে হতে পারে তার অগ্রযাত্রা। আশা করি রহস্যজনক হলেও থ্রিলারের মতো সেও সুন্দর হোক। দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে ৩ ক্যাটাগরিতে। মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম আর তথাকথিত ‘সাধারণ’ শিক্ষা। নামটা অসাধারণ হলে যদিও শিক্ষার্থীদের মাঝে অসাধারণ কিছু উদ্দীপনা থাকতেই পারতো। যাই হোক। একই দেশ৷ একই শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাহলে শিক্ষা আবার এতোভাবে কেন? যদি বিভাজন করতেই হয়, এমন কেন নয় যে, যে কেউ যেকোনো ধরণের প্রতিষ্ঠান বেছে নিবে, আর প্রতি ক্ষেত্রেই যা অর্জন করবে- তা হলো প্রকৃত শিক্ষা, মনুষ্যত্ব আর দক্ষতা? কাগজে কলমে হয়তো এমনই। কিন্তু বাস্তবেও কি তাই? দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর মাসিক ফি দিয়ে বাংলাদেশের অনেক পরিবারের ৩ মাস চলে যায় নিশ্চিন্তে। তাহলে কি এমন না- শিক্ষার ক্ষেত্রে জেনেবুঝে একটা বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে?
কথায় আসা যাক! এই বিচিত্র বিভাজনের যৌক্তিকতা কোথায় আমার একান্ত প্রশ্ন। অনেক সময় ক্ষোভেরও কারণ।
ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল গুলোতে কী হয় আসলে? সাধারণ শিক্ষার সাথে তার পার্থক্যটা উল্লেখ করা যাক। প্রথমত, তারা একটা ইন্টারন্যাশনাল সিলেবাসের সাথে যুক্ত থাকে। শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিয়ে পুলকিত হয়। অনেকেরই ধারণা আছে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলেমেয়েরা সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলে। যদি তাই হয়, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কম পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করছে? যদি কমই করে থাকে, তাহলে তার উন্নয়ন একান্তই কাম্য নয় কি যদি শিক্ষায় সমতা নিশ্চিত করতে হয়? সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা তাহলে কম ইংরেজি জানছে! যদিও দেশে বাংলা – ইংরেজি দুই ভার্সনেই সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে।
দেশে মাদ্রাসা রয়েছে ৩ ধরনের।মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার পার্থক্য হলো, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধি লাভ করে যা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করে না। ধর্মীয় মৌলিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সবার জন্যই রয়েছে – এটা প্রশংশনীয়।বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৌলিকভাবে কোরান হাদিস বোঝার জন্য যেসব আনুসঙ্গিক বিষয়াবলী প্রয়োজন সেগুলো পড়ানো হয়। ফেকাহ পড়ানো হয়। এর সাথে তাদের চার পাঁচটা ভাষার উপরেও তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়। বাংলা, ইংরেজি প্রাথমিক পর্যায়ে, আরবি উচ্চস্তর পর্যায়ে, পাশাপাশি উর্দুও তাদেরকে শেখানো হয়। অল্প ফারসিও তাদেরকে পড়ানো হয়। এক্ষেত্রে তৎকালীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সহসভাপতির উক্তি থেকে নেয়া- এখানে ইঞ্জিনিয়ার বানানো হয় না, বৈজ্ঞানিক বানানো হয় না, ডাক্তার হয় না, দার্শনিক হয় না। ইসলামি শিক্ষার মধ্যে গভীর জ্ঞানী হয়। এটা একটা বিভাগ যেখানে ইসলামী শিক্ষায় গভীর জ্ঞানী করে তোলা হয়।” সন্দেহ নেই মাদ্রাসা শিক্ষা দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। মাদ্রাসার ক্ষেত্রে পার্থক্যটা তাহলে বেশ স্পষ্ট। বিশেষ করে দেশের কিছু মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করা হয়।
কিন্তু পুনশ্চঃ কাগজে কলমে এসব থাকলেও বাস্তবতা অনেক সময় অন্যরকম। দেশের অনেক মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যই পর্যাপ্ত অন্যান্য বিষয় চর্চার সুযোগ কম। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কুরআন-হাদিস সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেন দেয়া হয়নি? অন্যান্য ধর্মের জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় গ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞান নিশ্চয়ই প্রয়োজন। হ্যাঁ, মনে হতে পারে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অত্যধিক চাপ পরবে। কিন্তু আসলেও কি তাই? অধিকাংশ মুসলিম শিক্ষার্থী কুরআন পড়ে এবং বোঝার চেষ্টা করে। যদি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সবাইকেই পড়ানো হতো খানিকটা ব্যাখ্যা সহ, (মাদ্রাসার চেয়ে কম), তাহলে নৈতিক শিক্ষা কি আরেকটু জোরদার হতো না? আর অনেক মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পরে। মানি, ব্যাতিক্রম আছে। কিন্তু এক গ্লাস পানিতে দশ দানা চিনিতে তেমন আর কি পরিবর্তন হয় যদি উদ্দেশ্য থাকে দুটোর সংমিশ্রণে সুস্বাদু শরবত তৈরি?
আচ্ছা, এমন হলে কেমন হয়? দেশে সাধারণ আর অসাধারণ বলে কোনো শিক্ষা নেই৷ সব এক।
ধরুন, সব শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি জানবে, আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাসে গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি পড়বে আর সাথে থাকবে নিজ নিজ ধর্মীয় গ্রন্থ সম্পর্কে সুস্পষ্ট শিক্ষা৷ তাছাড়া ঐচ্ছিক হিসেবে আরবি, সংস্কৃত, হিব্রু এগুলোও যুক্ত হতে পারে৷ এখন যদি প্রশ্ন হয় মাদ্রাসায় আগে যা জানতো, তার চেয়ে কম জানবে না কি? উত্তর হলো আমার অভিজ্ঞতায় মাদ্রাসায় খুব বেশি আসলে জানানোও হয় যে – এমন না। আর দেশে উচ্চতর শিক্ষায় ইসলামি শিক্ষা তো রয়েছেই। কাজেই সত্যিই যদি বিশদভাবে জ্ঞান প্রয়োজন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিঃসন্দেহে মাদ্রাসার আংশিক অপূর্ণ শিক্ষার চেয়ে উত্তম। আর যাঁরা সত্যিকারভাবে ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করাতে চান, তাঁরা এটাও জানেন কুরআন বিজ্ঞান গ্রন্থ, অর্থনীতি, রাজনীতি- সবই এতে রয়েছে৷ মুসলিমদের ইতিহাস তো তাই বলে। মূল ইসলামি শিক্ষা তো কুরআন কেন্দ্রিক৷ মসজিদেই চলতো জ্ঞানার্জন। আর সেখান থেকেই তো বিকশিত হয় জ্যামিতি, রসায়ন, চিকিৎসা, এলজেবরা! আমার কথার গুরুত্ব নাই থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাস তো গুরুত্বপূর্ণ! তাই নয় কি? তাহলে কেন সাধারণ আর মাদ্রাসার বিভাজন!
এতোক্ষণ শুধু বিভাজনের যুক্তি আর তার খণ্ডায়নই করে গিয়েছি। এবার আশা যাক বিভাজনের সমস্যায়। শুরুতেই শিক্ষায় একটা খুব বাজে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তাছাড়া ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশপ্রেম বা সংস্কৃতি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার সুযোগ নেই। ব্যাতিক্রম বাদ দিয়ে বলছি। যা আমাদের অপসংস্কৃতি আর অপরাধেও নিতে পারে। উদাহরণ তো নিয়মিতই চোখে পরে।
সবকিছুর উর্ধ্বে জাতীয় উন্নয়নে সামগ্রিক শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা হোক আনন্দের, হোক সত্যের, হোক মানুষের। মনুষ্যত্ব বিকশিত হোক। অন্ধকারে ডুবে থাকা রাতের পরে নতুন সূর্য যে আসবে। আসতেই হবে।