জাতীয়প্রধান খবর

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ১৫০তম জন্মদিন আজ

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পুরো নাম আবুল কাসেম ফজলুল হক। ‘বাংলার বাঘ’ হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারেও তার ছিল উজ্জ্বল অবদান।

ইতিহাস গবেষকরা শেরে বাংলাকে সমাজ গঠনে প্রজ্ঞাবান নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন।তার অসামান্য অবদানের কথা বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইতিহাস বলছে, শেরে বাংলা ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে এসে তা বঙ্গবন্ধু সমাপ্ত করেছেন স্বাধীনতা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, শেরে বাংলা বাঙালি সত্তার জনক। তিনি চাষি প্রজার জনক। তাকে নিয়ে ভালো কিছু লেখা হয়নি, করা হয়নি। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরার জন্য ভালো একটি জীবনগ্রন্থ লেখা হতে পারে, তার জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আমি আশা করব শেরে বাংলাকে নিয়ে ভালো কিছু লেখা হোক।

ড. অনুপম বলেন, ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা। যদিও কিছুদিন পর ওই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়।৫৪ সালে তার দেওয়া ২১ দফা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আওয়ামী লীগ সেটার সঙ্গে ছিল।

আজ ২৬ অক্টোবর শেরে বাংলার ১৫০তম জন্মদিন। ১৮৭৩ সালের আজকের দিনে কাজী ওয়াজেদ আলীর পুত্র এ কে ফজলুল হক পৃথিবীতে আসেন। ব্রিটিশ ভারতের বাকেরগঞ্জে (বর্তমানে ঝালকাঠি) তার জন্ম হয়। তার মা সায়েদুন্নেসা খাতুন। একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় তার। তার বাবা ছিলেন বরিশাল বারের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। মাত্র ২১ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে তার।

এ কে ফজলুল হক ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনসহ আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। উচ্চশিক্ষা নেন কলকাতায়। ১৮৯৪ সালে তিন স্নাতক ডিগ্রি পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ইংরেজিতে প্রথম ভর্তি হন তিনি। ভর্তির পর কোনো এক সহপাঠীর ব্যঙ্গ ছিল, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না কারণ তারা মেধাবী নয়। প্রবল জেদে অঙ্কশাস্ত্রে ছয় মাস লেখাপড়া শেষে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতেই পাস করেন গুণী এই নেতা। তারপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইন বিভাগে লেখাপড়া শেষ করেন।

শেরে বাংলা ৩৯ বছর বয়সে প্রথম বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বিপ্লবী-আপোসহীন এই নেতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজের অনমনীয় অবস্থানের কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন। সামনের সারিতে থেকে পুরো ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেন তিনি। পরে পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও হয়ে ওঠেন এ কে ফজলুল হক।

অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও মেয়র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন। ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলের নেতৃত্ব দেওয়ারও সুযোগ হয়েছে এ কে ফজলুল হকের। ২০০৪ সালে ‘বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেঠ বাঙালি’ জরিপে চতুর্থ স্থান পেয়েছেন অভিবক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথম বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতেই রাজনীতির লক্ষ্য ছিল তার। পিছিয়ে পড়া মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভেতরে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ফজলুল হক মনে করতেন, মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ কেবল শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ। তাই সুযোগ পেয়েই তিনি কলকাতায় ইসলামিক কলেজ, রাজশাহীর আদিনা ফজলুল হক কলেজ, ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজ ভবন, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েন। সেসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণ তার নামেই। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস, স্টেডিয়ামের নামকরণের মধ্যে বেঁচে আছেন তিনি।

ফজলুল হক প্রান্তিক মানুষের জীবন কাছ থেকে দেখে সর্বপ্রথম ভেবেছেন গরিব চাষিদের মর্যাদার কথা, কীভাবে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটানো যায় সেই কথা। তিনি দেখলেন, বাংলার প্রাণ ছিল রক্ত ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষকরা। অথচ তাদের শোষণ করে ফুলেফেঁপে উঠছে একদল জমিদার ও মহাজন। ফজলুল হক ভেবে দেখলেন কৃষকদের অধিকাংশ মুসলমান এবং জমিদারদের অধিকাংশ উচ্চবর্গীয় হিন্দু। সমস্যাটি সেখানে কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টাও করলেন। দেখলেন এটি সম্প্রদায়ভিত্তিক সংকট নয়, শ্রেণিগত। এরপরই ভাবলেন কৃষক আন্দোলনের কথা। গড়ে তুললেন নিজের কৃষক প্রজা সমিতি নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে কিছু সংস্কার সাধনে এগিয়ে এলেন। ভারতবর্ষ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই আইন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাজনার হারে রাশ টানলেন। আমূল ভূমি সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করলেন। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী ৫৪ শতাংশ পদ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের নির্দেশ দিলেন। এসব করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে কৃষক প্রজা সমিতি বন্ধ করে তিনি সদল বলে মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। প্রাদেশিক সরকার পুরোপুরি মুসলিম লীগ সরকারে পরিণত হলো। শেরে বাংলার মুসলিম লীগে যোগদানের ফলে দলটির অভাবনীয় প্রভাব-বিস্তার বাড়ে।

সাহিত্যিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে লেখেন, ‘পার্টির নেতাদের অনুরোধে একদিন আমি তাকে (শেরে বাংলা) মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা সমিতি উভয়টার সভাপতি থাকার স্ববিরোধী কাজ না করিয়া একটা হইতে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলাম। … তিনি বলিলেন, ‘মুসলিম লীগ করা যেমন ভারতীয় মুসলমানের জন্য দরকার, কৃষক-প্রজা-সমিতি করা তেমনি বাংগালী মুসলমানের জন্য দরকার। তিনি কৃষক-প্রজা-সমিতির সভাপতিত্ব ছাড়িয়া দিয়া এটাকে কংগ্রেস নেতাদের হাতে তুলিয়া দিতে পারেন না। তেমনি মুসলিম লীগের সভাপতিত্ব ছাড়িয়া দিয়া ওটাকে খাজা-গজাদের হাতে তুলিয়া দিতে পারেন না। ’

প্রাবন্ধিক গৌতম রায় তার একটি লেখায় বলেন, ‘মুসলমান মানেই মুসলীম লীগ নয়, মৌলবাদী নয়। দেশ ভাগের উগ্র সমর্থক নয়, হিন্দু বিদ্বেষী নয়। ’

এখনকার রাজনীতিতে শেরে বাংলাকে আর সেইভাবে মূল্যায়ন করতে দেখা যায় না। তার মত ও আদর্শ ধারণ করে এরকম আলাদা কোনো রাজনৈতিক দলও নেই।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু দেশ রূপান্তরকে বলেন, শেরে বাংলাকে নিয়ে মূল্যায়নের অনেক দিক রয়েছে। মূলত তিনটি বিষয়ের জন্য সব সময় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মহান এই ব্যক্তিত্ব। এর একটি বাঙালি জাতির উন্মেষ, দ্বিতীয়টি পিছিয়ে পড়া বাঙালির শিক্ষাদীক্ষায় উন্নতি সাধন বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষায়। আর তৃতীয়টি হলো অবিভক্ত ভারতবর্ষে ঋণ সালিশী বোর্ড গঠন।

আমু বলেন, শেরে বাংলার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব লাহোর প্রস্তাব। সেখানে তিনি বাংলা ভাগ করতে চাননি। প্রস্তাব রেখেছিলেন বাংলা ভাগ না হওয়ার, সেটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলেও ১৯৪২ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও প-িত নেহরু গান্ধী মিলিতভাবে সেই প্রস্তাব বাতিল করেন। শেরে বাংলা তার প্রতিটি কাজে বাংলা প্রীতি দেখিয়েছেন, এ জন্যই তিনি শেরে বাংলা নামে পরিচিতি পেয়েছেন।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button