আন্তর্জাতিক খবর

পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি: বাড়ছে ঋণ-সম্পত্তি বিক্রি

[আমজাদ ইকবাল ও মুহাম্মদ উসমান মল্লিকের প্রতিবেদনটি পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক দ্য ডনে প্রকাশিত। ভাষান্তর: নাজমুস সাকিব রহমান]

পাকিস্তানে শিশুদের দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করার শিক্ষা দেয় পরিবারের সদস্যরা। এই সঞ্চয় নগদ অর্থ, সম্পদ বা স্বর্ণও হতে পারে। প্রয়োজন ভেদে দেশটিতে দুর্দিনের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়। সেক্ষেত্রে বিয়ে, আকস্মিক অসুস্থতা এবং ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে কাজে লাগে সঞ্চয়।

যদিও বর্তমান বিদ্যুৎ বিল, বাচ্চাদের স্কুল ফি, বাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য খরচের মতো দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এসব সঞ্চয় কাজে লাগানো হচ্ছে। বলা যায়, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণেই এসব সঞ্চয় কাজে লাগাতে বাধ্য হচ্ছেন পাক নাগরিকরা।

পাঞ্জাবের তক্ষশিলার বাসিন্দা জুবাইদা বিবি। স্বামী গত হয়েছেন আগেই। বর্তমানে তিনি বিলাল কলোনিতে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। গত আগস্ট মাসের বিদ্যুৎ বিল দিতে তিন দশকের পুরনো বিয়ের আংটি বন্ধক রেখেছেন তিনি। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য টাকা ধার করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার। তবে পেনশন পাওয়ার পর বন্ধক রাখা আংটিটি ফিরে পাওয়ার আশা ছিল জুবাইদার। যদিও এখনও তা পারেননি তিনি।

প্রায় একই অবস্থা ৪০ বছর বয়সী আহমেদ জামানের। করাচির এই বাসিন্দা তার ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মাসে প্রায় দেড় লাখ রুপি আয় করেন তিনি। গত বছর পর্যন্ত পরিবারের খরচ মেটাতে এই আয় যথেষ্ট ছিল তার জন্য, কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই।

আহমেদ জামান বলেন, ‘চলতি মাসে আমি আমার স্ত্রীর কাছে ধার চেয়েছিলাম। আমাদের বিয়েতে পাওয়া স্বর্ণের কানের দুল বিক্রি করে সে আমাকে টাকা দিয়েছে। আমি যে বাড়িতে থাকি তার ভাড়া ৩৫ হাজার রুপি। শেষবার বিদ্যুৎ বিল ছিল ৪০ হাজার রুপির বেশি। আমার বেতনের অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলে।’

আহমেদ জামানের মতো না হলেও প্রায় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে ২৫ বছর বয়সী হুসেন শাব্বিরের পরিবারে। তাদের সাত সদস্যের পরিবারে তিনজন মিলে এক লাখ ৩০ হাজার রুপি উপার্জন করেন। এরপরেও তাদের পক্ষে সংসার খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাস ধরে মাসের শেষে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে শাব্বিরকে। আর এভাবেই জড়িয়ে যাচ্ছেন ঋণের জালে।

শাব্বির বলেন, ‘আমি একজনকে টাকা ফেরত দিই। পরের মাসের জন্য আবারও ঋণ নিই। আমার বাবা এবং ভাইও একই রকম ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন।’ তবে শাব্বিরের পরিবার কিছু ঋণ পরিশোধের জন্য তাদের গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। এতে হাতে বেশ কিছু টাকাও এসেছে। কিন্তু পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি না কমায় তারা আশঙ্কা করছেন ঋণের জালে না জড়ানোর এই স্বস্তি বড়জোর কয়েক মাস স্থায়ী হবে।

এদিকে মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে যেসব পরিবারের সম্পদ বিক্রি বা ঋণ করার প্রয়োজন হচ্ছে না, তারাও ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে ৩১ বছর বয়সী সমীর রশিদের কথা বলা যায়। সম্প্রতি বাবা হয়েছেন তিনি। ভেবেছিলেন মাসে এক লাখ রুপি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট হবে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

সমীর বলেন, ‘আমার নবজাতকের জন্য মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার রুপি খরচ হয়। কখনও কখনও এর চেয়েও বেশি হয়।’ চলতি মাসে তিনি ৩০ হাজার রুপি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছেন। এছাড়াও মোটরসাইকেলের জ্বালানি বাবদ ১৩ হাজার রুপি খরচ হয় তার।

সমীর জানান, তিনি ইতোমধ্যেই পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার মতো অর্থ তার কাছে নেই। যদিও ব্যয় সংকোচন সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যৌক্তিক উপায় বলে মনে করা হয় কিন্তু এটি খুচরা বিক্রেতাসহ পরিষেবা শিল্পের অন্যদের জন্য দুর্দশা সৃষ্টি করছে যারা এই ব্যয়ের উপর নির্ভর করে।

তক্ষশিলার লালারুখ এলাকায় একটি হাঁস-মুরগির দোকান রয়েছে এহসান আলীর। বর্তমানে তার বিক্রি আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ কমে এসেছে। প্রতিদিনের ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় তিনি এখন দোকান চালানোর জন্য হোটেল, রেস্তোঁরা এবং বিয়ের ওপর নির্ভর করছেন।

এহসান আলী বলেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে হাঁস-মুরগির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ক্রেতারা এখন মাংসের পরিবর্তে মুরগির যকৃত, পা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের মাংস খাওয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই।

একইভাবে সেখানে হোটেলে কমছে চায়ের অর্ডারের সংখ্যা। বেশিরভাগ বিক্রেতা, চালক এবং দিনমজুর পুরো কাপের পরিবর্তে আধা কাপ চা অর্ডার করছেন। অন্যদিকে হোটেলে কিমা, কোরমা ও গরুর মাংসের বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশ। কারণ ক্রেতারা এখন শাকসবজি ও মসুর ডালের মতো সস্তা খাবার পছন্দ করে।

বলা যায়, পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এক ধাপ নিচে নামতে বাধ্য হচ্ছে। প্রায় সবকিছুর জন্য তাদের একটি সস্তা বিকল্প বেছে নিতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের পছন্দের খাবার, বাড়ি, গাড়ি এবং শিশুদের শিক্ষা।

ফয়সাল শহীদ রোডের একটি মাদ্রাসার প্রশাসক হুমায়ূন ভাট। তার দাবি, গত দুই মাসে মাদ্রাসায় শিশু ভর্তির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ দেশটির বাসিন্দারা বেসরকারি স্কুলের ফি ও অন্যান্য খরচের চাপে বিপর্যস্ত। তারাই শিশুদের বেসরকারি স্কুল থেকে মাদ্রাসায় নিয়ে যাচ্ছেন।

আর এই তালিকায় রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তারা শিশুদের মাদ্রাসায় ভর্তি করছে, কারণ প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা দিচ্ছে।

হুমায়ূন ভাট বলেন, অতীতে এতিম এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা মাদ্রাসায় ভর্তি হত। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন বদলাচ্ছে। এখন মানুষ তাদের সন্তানদের খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখে না। এমনকি তাদের সন্তানদের এমন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হচ্ছে যেখানে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয় ও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানে চলমান অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকলে কী হবে? উত্তর দিতে গিয়ে দেড় দশকের বেশি আগের একটি গবেষণার কথা স্মরণ করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কায়সার বাঙালি। ওই গবেষণায় দেখা যায় – এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ৩০টি পরিবারের চিকিৎসা জনিত সমস্যা রয়েছে। তাদের অর্ধেক রোগীর ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন ছিল, অন্য অর্ধেকের পরিবারে ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন।

ড. কায়সার বাঙালি বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি ওই পরিবারগুলো চিকিৎসা ব্যয় বহন করার জন্য তাদের গাড়ি, স্বর্ণ এমনকি সম্পত্তিও বিক্রি করেছিল। যদিও অনেক ক্ষেত্রে রোগ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় রোগী বাঁচতে পারেনি। এটি পরিবারের উপর মারাত্মক মানসিক এবং আর্থিক প্রভাব ফেলে।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে এখন একই রকম ঘটনা ঘটছে। কারণ তারা বিদ্যুৎ বিল, জ্বালানি বা যাতায়াত খরচের মতো পুনরাবৃত্তি ব্যয় মেটাতে সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি টেকসই উপায় নয়।

তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে অনেকে গাড়ি ব্যবহার না করে মোটরসাইকেল বেছে নিয়েছেন। যেখানে আগে যারা দুই চাকার গাড়ির মালিক ছিলেন তারা গণপরিবহনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা দূর না হলে শিগগির এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যেখানে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে শিশুদের স্কুলে পাঠাবেন নাকি কর্মক্ষেত্রে যেতে ট্যাঙ্কে জ্বালানি ভরবেন।

এক পর্যায়ে দুই দশক আগে সোশ্যাল পলিসি ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের আরেকটি গবেষণার কথা স্মরণ করেন ড. কায়সার বাঙালি। যেখানে তিনি ও তার দল দেখেছেন উপহার দেওয়া এড়ানোর জন্য মানুষ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এসব বিষয়গুলো স্বাভাবিক নয়। এটি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন করেন, একজন ব্যক্তি কী করবে যখন তার পরিবার তার কাছে কিছু চাইবে এবং সে তা দিতে সক্ষম হবে না? সে কিভাবে তার স্ত্রী-সন্তানের মুখোমুখি হবে?

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button