কী চায় হামাস, কেন এ লড়াই?

[আল-জাজিরা অবলম্বনে]

ইসরাইলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস। ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে হাজারখানেক মানুষের। এর সূত্রপাত শনিবার, ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামাসের নজিরবিহীন রকেট হামলার মধ্য দিয়ে। মাত্র ২০ মিনিটে হাজার পাঁচেক রকেট ছুড়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে হামাস। ভেদ করেছে ইসরাইলের নিশ্ছিদ্র সুরক্ষাবলয়কে।

শুধু তা–ই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে ইসরাইলে ঢুকে পড়েছেন হামাস যোদ্ধারা। শুরুতে হতবাক হলেও দ্রুত পাল্টা জবাব দেয় ইসরাইল। পাল্টা আক্রমণ করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়। এর পর থেকে ফিলিস্তিনে মুহুর্মুহু বোমা পড়ছে। রবিবার হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। দেশটির কট্টর ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘এটা দীর্ঘ ও জটিল একটি যুদ্ধ’।

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যেসব ইসরাইলি অবৈধ বসতি স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত, শুধু তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। বসতি স্থাপনকারী ও বেসামরিক লোকজনের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ করে থাকেন। তারা বেসামরিক নন।

এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন সামনে এসেছে, হামাস আসলে কারা? হামাসের উদ্দেশ্য কী? কেনই–বা হামাস হঠাৎ এতটা মারমুখী হয়ে উঠল? পরিণতি জানা থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলে হামলা চালাল?

ফিলিস্তিনের কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হামাস। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরাইলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। কট্টর ইসরাইলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন ও আবদেল আজিজ আল-রান্তিসির হাতে গাজায় হামাস প্রতিষ্ঠা পায়। ২০০৪ সালের মার্চে গাজায় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন আহমাদ ইয়াসিন। পরের মাসেই নিহত হন আজিজ আল-রান্তিসি।

হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত, এর সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাশেম ব্রিগেডসের মাধ্যমে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা। বিশেষত ইসরায়েলি দখলদারত্বের কারণে ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনিদের কল্যাণে কাজ করা।

সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী, তারা ইসরাইলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরাইল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র।

২০০৭ সাল থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা রাজনৈতিকভাবে হামাসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের গাজায় ২০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। ফিলিস্তিনি ফাত্তাহ গ্রুপের সঙ্গেও লড়াই করেছে হামাস।

কী চায় হামাস

১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর নির্ধারণ করা ফিলিস্তিন সীমান্ত মেনে নিয়েছে হামাস। তবে সংগঠনটি কখনোই স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের অস্তিত্ব মানেনি। হামাস নেতা খালেদ মিশাল ২০১৭ সালে বলেছিলেন, ‘দখলদারি যত দিন ধরে চলুক না কেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের এক ইঞ্চি মাটিও আমরা ছাড়ব না।’

এমনকি ১৯৯০-এর দশকে ইসরাইল ও পিএলওর মধ্যকার সমঝোতাকে নাকচ করে দিয়েছে হামাস। এ সমঝোতা অসলো শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। নানা সময় চালানো হামলায় ইসরাইলি সেনা, বসতি স্থাপনকারী এবং বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মিসর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে হামাস ও এর সামরিক শাখা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে পরিচিত।

যারা সমর্থন জোগায়

হামাসের বেশ কিছু আঞ্চলিক সমর্থক রয়েছে। তারা হলো ইরান, সিরিয়া ও লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী হিসেবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েল নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীতির বিরোধিতা করে হামাস ও তার মিত্ররা।

হামাসের বেশ কিছু আঞ্চলিক সমর্থক রয়েছে। তারা হলো ইরান, সিরিয়া ও লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী হিসেবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েল নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের নীতির বিরোধিতা করে হামাস ও তার মিত্ররা।
মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সশস্ত্রগোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদ। ইসরায়েলবিরোধী অভিন্ন মনোভাব সশস্ত্র এই সংগঠনের সঙ্গে হামাসকে কাছাকাছি এনেছে। একযোগে কার্যক্রম চালিয়েছে সংগঠন দুটি। তবে বিভিন্ন সময় ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কে ফাটল ধরতেও দেখা গেছে।

হঠাৎ হামলার কারণ কী

হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দশকের পর দশক ধরে চরম নৃশংসতার শিকার হয়ে আসছেন ফিলিস্তিনিরা। এর প্রতিক্রিয়ায় তারা ইসরাইলে হামলা চালিয়েছেন।

খালেদ কাদোমি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা বন্ধ করবে। পবিত্র স্থান আল-আকসায় সংঘাত বন্ধ করবে। এটাই আমাদের চাওয়া। এসবই এবারের হামলার পেছনের কারণ।’

শনিবারের হামলাকে ‘কেবল সূচনা’ বলে উল্লেখ করেছে হামাস। সেই সঙ্গে এ লড়াইয়ে অন্য সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

লক্ষ্যবস্তু কি বেসামরিক মানুষ

এবারের হামলার পর অনেক ইসরাইলিকে আটক করেছে হামাস। তাদের মধ্যে কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিও আছেন। এই ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরও হামাসের জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র ওসামা হামদান বলেন, হামাসের পক্ষ থেকে কখনোই বেসামরিক মানুষের ওপর আক্রমণ করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিষয়টি সামনে এনেছে। বলেছে, হামাসের সদস্যরা ইসরাইলের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের হত্যা করেছেন।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ওসামা হামদান বলেন, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যেসব ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত, শুধু তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। বসতি স্থাপনকারী ও বেসামরিক লোকজনের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ করে থাকেন। তারা বেসামরিক নন।