ক্রিকেটখেলাধুলাপ্রধান খবর

টিকে রইল টাইগারদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আশা

দারুণ জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু টাইগারদের। কিন্তু কে জানতো পরের ম্যাচ থেকে হতাশার কালো মেঘ ঘিরে ধরবে বাংলাদেশকে। ধর্মশালার সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই বাংলাদেশকে প্রথম হারের স্বাদ দেয় ইংল্যান্ড। দুর্ভাগ্য বশতঃ সেটিই ইংলিশদের একমাত্র জয় এবারের বিশ্বকাপে। কিন্তু বাংলাদেশকে যেন খাদের কিনারায় ঠেলে দিল। যেখান থেকে আর ফিরতে পারেনি। একের পর এক হারে কোনঠাসা হয়ে পড়ে টাইগাররা। টানা ছয় ম্যাচে হেরে এক পর্যায়ে যেন জয়ের ক্ষুধাটাও মরে যায় সাকিব–মুশফিকদের।

যেখানে হারতে হয় নেদার‌্যলান্ডসের মতো দলের কাছেও। টানা অর্ধ ডজন হারে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ শিবিরে সে ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার শেষ সুযোগ ছিল শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটি। বিশ্বকাপে দুটি ম্যাচে জিতলেও বাংলাদেশের চাইতেও বিধ্বস্ত লংকানরা। তাই এই দলটিকে হারিয়ে দ্বিতীয় জয় তুলে নেওয়াটা ছিল একেবারেই সুবর্ণ সুযোগ। আর সে সুযোগটাকে বাংলাদেশ কাজে লাগিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। ছয় ম্যাচে হারের পর অবশেষে স্বস্তির জয় পেল টাইগাররা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ–শ্রীলঙ্কার ম্যাচ মানেই যেন বাড়তি উত্তেজনা। তবে এবার বিশ্বকাপে ধুঁকতে থাকা দুই দলের তলানির লড়াই এতটা ঝাঁজ ছড়াবে, কে ভাবতে পেরেছিল! অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের ‘টাইমড আউট’ ঘিরে যে উত্তাপ ছড়াল ম্যাচের প্রথম ভাগে, সেটির রেশ রইল ম্যাচজুড়েই। সেই চাপকে হারিয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে জয়ের পথে এগিয়ে নিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব আল হাসান। টিকে রইল বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার আশা। দিল্লিতে প্রবল স্নায়ুর চাপের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৩ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে চারবারের লড়াইয়ে এই প্রথম লঙ্কানদের হারাতে পারল বাংলাদেশ।

প্রথম ম্যাচের পর যে ব্যাটিংটা ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ সেটাই যেন ফিরে পেল গতকাল। আর তাতেই স্বস্তির জয় টাইগার শিবিরে। বল হাতে তানজিম সাকিব, সাকিব আল হাসান আর শরীফুলদের দাপটের পর ব্যাট হাতে সাকিব–শান্তর দুর্দন্ড প্রতাপ বাংলাদেশকে পাইয়ে দেয় দারুণ স্বস্তির জয়। যদিও ব্যাটিংয়ে শুরুতে ধাক্কা খেয়ে পথ হারানোর শংকায় ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দলকে সঠিক পথে নিয়ে যান সাকিব এবং শান্ত। দুজনই পেতে পারতেন সেঞ্চুরি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাওয়া হলো না। তবে হয়তো স্বস্তিটা এখানেই যে জয়টাতো এসেছে অন্তত। সাকিব–শান্তর ১৬৯ রানের জুটি দলকে জয়ের যে পথ দেখিয়েছিলেন সেটাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যান পরের ব্যাটাররা। এবারের বিশ্বকাপে যে দলটি আড়াইশ রানের ঘরে যেতে পেরেছেন কেবল দুইবার সে দলটি শেষ পর্যন্ত ২৮০ রান টপকে জয় তুলে নিয়েছে। তাও একেবারে পিট দেওয়ালে ঠেকে যাওয়া অবস্থায়।

দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে টসে জিতে শ্রীলংকাকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। শুরুটা দারুণ ছিল বাংলাদেশের বোলারদের। প্রথম ওভারেই মুশফিকুর রহিমের উড়ন্ত ক্যাচে কুশল পেরেরাকে ফেরান শরীফুল। তবে দ্বিতীয় উইকেটে কুশল মেন্ডিস আর নিসানকা যোগ করেন ৬১ রান। নিসানকা সাবলীল ব্যাটিং করলেও রানের জন্য ধুঁকতে থাকেন মেন্ডিস। ১২ তম ওভারে প্রথম আক্রমণে এসেই লঙ্কান অধিনায়ককে ফেরান সাকিব। এগিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে গিয়ে শরীফুলের ক্যাচে পরিণত হন মেন্ডিস। পরের ওভারে ৪১ রান করা নিসানকাকে বোল্ড করেন তানজিম সাকিব। পরপর দুই ওভারে দুই সেট ব্যাটারকে হারিয়ে চাপে পড়ে শ্রীলংকা। এরপর জুটি গড়েন সামারাবিক্রমা এবং চারিথ আশালাংকা। দুজনের চতুর্থ উইকেট জুটিতে আসে ৬৩ রান। এ জুটিও ভাঙেন সাকিব। ছক্কা মারতে গিয়ে স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন ৪১ রান করা সামারাবিক্রমা। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঘটে প্রথম এক বিরল ঘটনা। দেরিতে মাঠে নামায় টাইমড আউট হয়ে ফিরে যেতে হয় অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে। ক্রিকেটে তিন মিনিটের মধ্যে দুই ব্যাটারকে মাঠে ক্রস করতে হবে। এই বিশ্বকাপে সে সময়টা আরো এক মিনিট কম। কিন্তু ম্যাথিউস সময় নিয়ে ফেলেন ৫ মিনিট। তাই সাকিবের আবেদনে টাইমড আউট হন ম্যাথিউস। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আম্পায়ার মারাইস ইরাসমাস নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাকিবকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি সত্যিই এই আবেদন করছেন কি না। সাকিবের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে ম্যাথিউসকে সিদ্ধান্ত জানান আম্পায়াররা। ম্যাথিউস তখন হেলমেটের ছেঁড়া ফিতা দেখিয়ে নিজের সমস্যার কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন বাংলাদেশ অধিনায়ককে। কিন্তু কোনো কথা বলতে চাননি সাকিব। তিনি ইশারায় দেখিয়ে দেন আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাতে কোনো লাভ হয়নি ম্যাথিউসের।

আবার জোড়া উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে শ্রীলংকা। কিন্তু এবার হাল ধরেন চারিথ আশালাংকা এবং ধনঞ্জয়া ডি সিলভা। দুজন মিলে ষষ্ঠ উইকেটে যোগ করেন ৭৮ রান। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে স্টাম্পড হয়ে ৩৪ রান করা ধানাঞ্জয়া ফিরলে ভাঙে এ জুটি। এরপর নিচের সারির ব্যাটারদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান আসালাঙ্কা। ৪৮তম ওভারে শরিফুল ইসলামের বলে বাউন্ডারি মেরে ৯৪ থেকে ৯৮ রানে পৌঁছান তিনি। পরের বলে ২ রান নিয়ে পূর্ণ করেন বিশ্বকাপে প্রথম ও ওয়ানডেতে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ১০১ বলে ৬টি চার এবং ৪টি ছক্কার সাহায্যে সেঞ্চুরি পূরণ করেন আশালাংকা। এরপর বেশি দূর যেতে পারেননি বাঁহাতি এই ব্যাটার। তানজিম সাকবিকে ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে তিনি ফিরেন ১০৫ বলে ১০৮ রান করে। একই ওভারের কাসুন রাজিথাকে ফিরিয়ে নিজের তৃতীয় উইকেট তুলে নেন তানজিম সাকিব। এরপর সামিরা রান আউট হলে ৩ বল বাকি থাকতে ২৭৯ রানে অল আউট হয় শ্রীলংকা। বাংলাদেশের তানজিম সাকিব ৩ উইকেট নিলেও দশ ওভারে রান দিয়েছেন ৮০। ২টি করে উইকেট নিয়েছেন সাকিব এবং শরীফুল। তাসকিন উইকেট না পেলেও ১০ ওভারে রান দিয়েছেন মাত্র ৩৯।

২৮০ রানের বড় টার্গেট। সে টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই বিবর্ণ বাংলাদেশ। বরাবরের মতো এবারেও ব্যর্থ বাংলাদেশ দলের ওপেনিং জুটি। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে দলের রান যখন ১৭ তখন ফিরেন তানজিদ তামিম। ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ তামিম এই ম্যাচেও বের হতে পারলেন না ব্যর্থতার বলয় থেকে। ৯ রান করেন এই ওপেনার। লিটনও পারলেন না দলকে টানতে। দ্বিতীয় উইকেটে শান্তর সাথে যোগ করতে পারলেন মাত্র ২৪ রান। ২২ বলে ২৩ রান করা লিটনকেও ফিরিয়েছেন দিলশান মাদুশাংকা। ৪১ রানে দুই ওপেনারকে হারানোর পর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শান্ত এবং সাকিব। তাদের সে প্রতিরোধ দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। ৫০, ১০০, ১৫০ করে এগিয়ে যাচ্ছিল দুজনের পার্টনারশিপ। কিন্তু ১৬৯ রানে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হলেন দুজন। ম্যাথিউসের বল ফ্লিক করতে গিয়ে ক্যাচ উঠে যায় সামনে। আর সে ক্যাচ সহজেই লুপে নেন আসালাংকা। সাকিব ফিরেন ৬৫ বলে ৮২ রানের অধিনায়কোচিত ইনিংস খেলে। যেখানে তিনি ১২টি চারের পাশাপাশি মারেন ২টি ছক্কা। সাকিবকে ফেরানোর পরের ওভারেই ম্যাথিউস আবার আঘাত হানেন। এবার তিনি ফেরান সাকিবের দীর্ঘক্ষণের সঙ্গী নাজমুল হোসেন শান্তকে। সেঞ্চুরির একেবারে কাছে গিয়ে ৯০ রান করে বোল্ড হয়ে ফিরতে হলো শান্তকে। তাও বলটা টেনে এনে বোল্ড হয়েছেন এই বাঁহাতি। ১০১ বলের ইনিংসে ১২টি চার মেরেছেন শান্ত। সাকিব–শান্তদের দেখানো পথে ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মাহমুদউল্লাহ–মুশফিক। কিন্তু ৩৮ রান যোগ করার পর ১০ করে বোল্ড হয়ে ফিরেন মুশফিক। এরপর মাহমুদুউল্লাহও পারলেন না ম্যাচটা শেষ করে আসতে। ২৩ বলে ২২ রান করে তিনিও ফিরলেন বোল্ড হয়ে। সাবলিল গতিতে এগিয়ে যাওয়া ম্যাচটিতে হঠাৎ চিন্তার রেখা। ১০ ওভারে যেখানে দরকার ১১ রান সেখানে মিরাজ গেলেন উড়িয়ে মারতে। দিতে হলো খেসারত। ফিরলেন দলকে চাপে ফেলে ৩ রান করে। তবে তাওহিদ হৃদয় আর তানজিম সাকিব মিলে ৫৩ বল আর ৩ উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নিয়ে তবেই ফিরেন। ৭ বলে ১৫ রান করে অপরাজিত থাকেন তাওহিদ হৃদয়।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button