সাহিত্য

নিভৃতচারী প্রত্নগবেষক লেখক আহমেদ আবদুল্লাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের শিকড়ে রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাসগুলোর গল্প জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ করে। আর সেই ইতিহাসগুলো খনন করে বের করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। দেশে এমন একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক আছেন যাদের হাতে আমাদের লুব্ধ ইতিহাস নতুন করে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এমন মানুষদের নাম কজনেই জানেন। এমন এক নিভৃতচারী প্রত্নগবেষক ডক্টর আহমেদ আবদুল্লাহ।

মাটির নিচের গল্প যেমন খনন করে বের করেন প্রত্নতাত্ত্বিক আহমেদ আবদুল্লাহ, তেমনি কলমের কালিতে সেই গল্পগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন পাঠকের মাঝে।

ডক্টর আহমেদ আবদুল্লাহ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কর্মস্থল বগুড়ায়। বর্তমানে ঢাকার সাভারে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও আহমেদ আবদুল্লাহর আদি বাড়ি টাঙ্গাইলে।

১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার শ্রীবড়টিয়া গ্রামে মোহাম্মদ আলী আকবর মিয়ার ঘরে জন্ম এই গবেষকের। পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান। বড় দুই বোনের পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার ছোট আরেকটি ভাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব থেকে তিনি বেড়ে উঠেছেন ঢাকার শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া এবং পীরেরবাগে।

আহমেদ আবদুল্লাহর শিক্ষাজীবনের শুরু কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর দ্বিতীয় শ্রেণি হতে এসএসসি পর্যন্ত শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। ১৯৯০ সালে নটরডেম কলেজ হতে এইচএসসি সম্পন্ন করে ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। ১৯৯৭ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক।

কর্মজীবন

২০০০ সালে তিনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে একজন কর্মজীবী হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি প্রত্নতত্ত্বে ২০১৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিএইচডি এর শিরোনাম ছিল ‘A study on early a migration and cultural importance of sylhet area: based on stray findings and excavated archaeological materials’।

প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়াও ডক্টর আহমেদ আবদুল্লাহ একজন উৎখননকর্মী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। কর্মজীবনের শুরুতে ২০০০ সালে কুমিল্লায় ভোজ রাজার বাড়ি উৎখননে যুক্ত হন। ২০০১, ২০০২ সালে বগুড়ার মহাস্থানগড় ফ্রান্স বাংলাদেশ যৌথ উৎখনন কাজে ছিলেন। ২০০৭ সালে বগুড়ার ভাসু বিহার, ও ঢাকার লালবাগ দুর্গে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে অংশ নেন।

এর আগে অবশ্য ২০০৩ থেকে ২০০৫ তিন বছর নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে খননে যুক্ত ছিলেন। পরে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে ঐতিহ্য অন্বেষণের সাথে উয়ারী বটেশ্বরে খনন কাজে অংশগ্রহণ করেন।

২০০৩ সালে উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আহমেদ আবদুল্লাহর দায়িত্বে থাকা ট্রেঞ্চে প্রথম দেয়াল কাঠামো উন্মোচিত হয়। অর্থাৎ তার হাত দিয়েই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নস্থলের প্রথম দেয়াল কাঠামো উন্মোচিত হয়।

এছাড়া ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালে ডক্টর আহমেদ আবদুল্লাহ শালবন বিহার ময়নামতিতে খনন কাজে একজন খননকর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এখানকার ১৩০০ বছরের প্রাচীন কূপটি তার হাত দিয়েই উন্মোচিত হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে (সপ্তম অষ্টম শতক) হাতিগাড়া মুড়া, কুমিল্লা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রানী ময়নামতির প্রাসাদে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকর্মী হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নস্থলের ইতিহাস উন্মোচনে একজন মাঠকর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কৃতিত্ব

দেশের বেশ কয়েকটি জাদুঘর যথা চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, ময়নামতি জাদুঘর, পাহাড়পুর জাদুঘরে তিনি বিভিন্ন সময়ে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বালিয়াটি জাদুঘর, মানিকগঞ্জ এর ডিসপ্লে’র কাজটি তার হাত দিয়েই করা। তবে এই ডিসপ্লে’র কাজে তার সাথে আরো একজন সহকর্মী ছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর সংগ্রহ এবং সংরক্ষণেও তার রয়েছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

২০০১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রত্নবস্তুর মূল রেজিস্টার তালিকা তার হাতেই করা হয়। যে রেজিস্টার তালিকাটি এখনো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ওয়ার্কশপে তিনি সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। সরকারি কাজে বিভিন্ন সময় তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, জাপান ও ফরাসি পত্রিকা তাকে নিয়ে গুরুত্ব সহকারে পৃষ্ঠাব্যাপী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার মধ্য দিয়ে এদেশের একজন গর্বিত প্রত্নকর্মী হিসেবে এশিয়া এবং ইউরোপে তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরেন।

লেখালেখি

আহমেদ আবদুল্লাহ এর সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির জগতে প্রবেশ একেবারে শৈশবকালেই। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় শিশু একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শিশু পত্রিকায় সেই ১৫ বছর বয়সে। যদিও লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল আরো আগে।

পরবর্তীতে বাংলার বাণী, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, আজকের কাগজ, নয়া দিগন্ত, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক পূর্বকোণ, পাক্ষিক পালাবদল, বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ধান শালিকের দেশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত অগ্রপথিকসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার বহু লেখা প্রকাশিত হয়।

তার প্রকাশিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৩টি। তন্মধ্যে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি, ঢাকার মুসলিম ঐতিহ্য, উপমহাদেশের মুসলিম ঐতিহ্য, নামকরণের নেপথ্যে, নামকরণের গোড়ার কথা, সপ্তাশ্চর্য, অংকের খেলা অংকের জাদু উল্লেখযোগ্য।

প্রশিক্ষণ

এছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ তিনি সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন। তন্মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন সংক্রান্ত সেমিনার, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, অটোমেশন অফ একাউন্টস সফটওয়ার বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, শিলালিপি তত্ত্ব ও মুদ্রাতত্ত্ব বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, মূর্তিতত্ত্ব বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, জাদুঘর ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, ই নথি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স, ইউনিকোড এর ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্সসহ নানাবিধ প্রশিক্ষণ কোর্স তিনি সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।

সম্মাননা

আহমেদ আবদুল্লাহ প্রত্নতত্ত্বে অবদানের জন্য ‘সমতটের কাগজ সম্মাননা’ এবং ‘উষসী সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা’ লাভ করেন। বর্তমানেও তিনি দাপ্তরিক দায়িত্ব এবং লেখালেখির কাজ সমান্তরালভাবে চলমান রেখেছেন।

বর্তমান প্রজন্মের জন্য একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক হিসেবে নিজেকে দাবি করেন ড. আহমেদ আব্দুল্লাহ। বললেন, আমার আগ্রহের জায়গা ভূগোল ও পরিবেশ, ধর্ম, শিল্পকলা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি এবং অবশ্যই প্রত্নতত্ত্ব। এই বাংলার প্রকৃতি, প্রেম, ইতিহাস, ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রাণান্তর চেষ্টা নিয়েই আমার লেখা।

এই বিভাগের অন্য খবর

এছাড়াও দেখুন
Close
Back to top button