বগুড়ায় ঈদে জোড়া খুন: ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির মেয়ের প্রাইভেটকারের সঙ্গে মোটরসাইকেলের টক্কর লাগা নিয়ে কথাকাটাকাটিকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় জোড়া খুনের সূত্রপাত ঘটে বলে নিহতদের স্বজনরা দাবি করছেন। বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপু প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে দুই যুবককে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় আরও একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
নিহত দুইজন হলেন, নিশিন্দারা চকর পাড়ার শরিফ ও রুমন। আহত যুবক হলেন হোসেন আকন্দ (১৯) একই এলাকার বাদল আকন্দের ছেলে। তারা গতকাল সোমবার ঈদের রাতে চকরপাড়া এলাকায় হামলার শিকার হন।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে নিহতদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে দুপুরে চকরপাড়া এলাকায় গিয়ে এসব বিষয় জানা যায়। এ সময় পুরো এলাকায় শোকের অবস্থা বিরাজ করছিল। এ ছাড়া স্থানীয়দের মাঝে থমথমে ভাব। অধিকাংশরা মুখ খুলছিলেন না।
ঘটনার সূত্রপাত গতকাল সোমবার ঈদুল আজহার রাত ১১ টা থেকে ১২ টার দিকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময় বগুড়া শহরের গোয়ালগাড়ি এলাকায় একমুখী সড়কে কালো রঙের প্রাইভেটকারে সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুর মেয়ে ও ভাতিজা যাচ্ছিলেন। এমন সময় উল্টো দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেল দ্রুত গতিতে গাড়িটির ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা হয়। পরে মোটরসাইকেল আরোহীরা ঘুরে গিয়ে হাকির মোড় এলাকায় যান। সেখানে টিপু মেয়ে-ভাতিজাদের সঙ্গে কয়েকজন যুবকের বাগবিতণ্ডা হয়। পরে ওই যুবকরা চলে যান।
চকরপাড়ার বাসিন্দারা বলেন, রাত সাড়ে ১২ টা থেকে একটার দিকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সার্জিল টিপু, তার ভাই সৈয়দ কবির আহমেদ মিঠু প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন লোক নিয়ে নিশিন্দারা চকরপাড়া এলাকায় যান। তারা সেখানে গিয়ে শরিফ, রুমন ও হোসেনকে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাদের দিকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়েন। এর মধ্যে শরিফ ও রুমনকে ছুরিকাঘাত করলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর হোসেন দৌড় দিয়ে পালিয়ে আসে। হোসেনকে হাসপাতালে চিকিৎসার দেয়ার পর ঘটনাগুলো জানতে পারেন ভুক্তভোগীর পরিবাররা।
হোসেন আকন্দ বলেন, ঈদের রাতে এলাকাতে শিক কাবাব আয়োজন করেছিল। শিককাবাব খেয়ে আমি বাসায় চলে আসি। রাতে আবার ফোন করে ডাক দেয় তখন রাস্তায় গেলে দেখি পাঁচ ছয়টি মোটরসাইকেলে অনেকজন হট্টগোল করছিল। সেখানে সাবেক কাউন্সিলর টিপু ছিলেন। আমরা গেলে আমাদের দিকে এলোপাথারি গুলি করে। গুলি করার পরপরই আমি দৌড় দিই। কিন্তু কেন আমাদের ওপর হামলা তার কিছুই জানি না।
হোসেনের বাবা বাদল আকন্দ জানান, রাতে টিপুর সাথে আরও লোকজন ছিল। তিনি গুলি করেছেন। তার লোকজন শরিফ ও রুমনকে খুন করেছে। আমার কথা, আমার ছেলের যদি দোষ থাকে তার অবশ্যই বিচার হবে। কিন্তু তাদেরও বিচার করতে হবে।
শরীফের মা হেনা বেগম বলেন, টিপুর মেয়ে যে গাড়িতে করে যাচ্ছিল সেই গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগছে। হয়তো সেখানে আরও কিছু হয়েছে। আমি জানি না। কিন্তু এ জন্য রাতে টিপু, তার ভাই মিঠু লোকজন নিয়ে এসে আমার ছেলেকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। পরে রাতে আশেপাশের বাড়ির লোকজন জানায় আমার ছেলের লাশ বাগানের পাশের গলিতে ওর লাশ পড়ে আছে।
শরীফের বোন নীলা জানান, ওরা (টিপু ও তার লোকজন) রাতে এলাকায় আসছে। অনেকগুলো গুলি করছে, ওদের মারছে। সবাই শুনছে। কিন্তু কেউ বাড়িত থেকে বের হয়নি।
শরীফ ও রুমনকে যেখানে হত্যা করা হয় তার থেকে ২০ মিটার দূরে রুমনের নানা বাড়ি। এখানেই তিনি বসবাস করতেন। রুমনের নানা শরিফুল ইসলাম বলেন, ও ছোট বেলা থেকে আমার কাছে মানুষ হয়েছে। আমার ডাক্তারি পেশা আছে। সেখানে রুমন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে। গতকাল আমি রাত ১০ টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। তখনও ও বাইরে ছিল। ঈদের দিন অন্যদের মতো সেও ঘুরে বেড়াচ্ছিল বলে আমি তেমন কোনো চিন্তা করিনি। রাতে হঠাৎ কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এর কিছুক্ষণ পর একজন বাসার গেটে এসে আমাকে ডাক দেয়। আমি তখন খুলিনি। আরও পরে স্থানীয়দের ডাকে বের হলে তারা জানায় রুমনকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে।
তবে এসব বিষয় জানতে সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুকে কল দেয়া হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। উপশহর এলাকার তার বাসভবনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে টিপু সকালে থেকে বাড়িতে নেই।
ঘটনাস্থলে রাতেই গিয়ে দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তাদের গায়ে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক রাউত গুলির খোসাও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ বলেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন ধরনের কথা শুনছি। সবগুলো আমরা আমলে নিয়ে এগোচ্ছি। নিহতদের ময়নাতদন্ত শেষে আজকে লাশ দাফন করবে পরিবার। তারপর আমাদের কাছে মামলার বিষয়ে আসতে চেয়েছে। তাদের স্টেটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে আমরা অভিযোগ নিবো। এ ঘটনায় ওই এলাকার একজন আহত রয়েছে। এ বিষয়ে আরো অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।