বগুড়ায় সাত মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ৮১ শতাংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের সাত মাসের বগুড়া থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ৮১ শতাংশ। একই সময়ে জেলা থেকে পণ্য রপ্তানির ধরণের পরিমাণও কমেছে। গেল বছরে সাত ধরনের পণ্য রপ্তানি হলেও এবার হয়েছে তিন ধরনের।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংস্থাটি বলছে, উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ এই জেলা থেকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা লাগে ২৩ সালে। সেবার রপ্তানি আয় কমে ৪০ শতাংশ। চলতি বছরে সেই ধাক্কা আরও গতিশীল হয়েছে রাজনৈতিক করণে।
আগামীতে পরিস্থিতি ভালো হবে আশা প্রকাশ করে বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মো. সাইরুল জানান, বগুড়ার পণ্যের গুনগত মান সেভাবে কমেনি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেই। এই পরিবেশে ব্যবসা ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। আবার অনেকে ঢাকা থেকেও প্রডাক্ট অব অরিজিন নিচ্ছে। এটিও রপ্তানি করার আরেকটি কারণ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রপ্তানি বাড়বে।
রপ্তানির সাথে জড়িত বগুড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের বৈশ্বিক অস্থিরতা আর চলমান বছরে রাজনৈতিক সংকট রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। এই কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিত খারাপ। বৈশ্বিক এবং স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে কোনো স্বাভাবিক হিসাব পাওয়া কঠিন।
চলতি বছরে বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বগুড়া থেকে ৩৩,০৮,৭৭৩ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছে ৩,০০,৯৮, ৫৫৫ মার্কিন ডলার। গত বছর প্রতি মাসে বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২৫,০৮,২১৩ মার্কিন ডলার। চলতি বছরের প্রতি মাসে এই জেলা থেকে ৫,৫১,৪৫৫ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের সাত মাসে গত বছরের তুলনায় ৮১ শতাংশ পণ্য রপ্তানি কমেছে।
বৈশ্বিক ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলার সংকটের কারণে রপ্তানি কমার আরেকটি কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, রপ্তানি ও আমদানির মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক আছে। রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকের সংখ্যা কমে গেছে। এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাব খুব বড় আকারে পড়েছে।
বগুড়া উত্তরের প্রাণ কেন্দ্র। বগুড়ায় তৈরি অনেক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি কোটি কোটি টাকা আয় করা হচ্ছে। কোনো বছর বেশি কোনো বছর কম। তবে চলতি বছরের মতো নেতিবাচক প্রভাব আগে কখনো পড়েনি।
জেলা চেম্বার কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বগুড়া থেকে রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। একই বছরে বগুড়া থেকে ১২ ধরনের পণ্য রপ্তানি হলেও ২০২৩ সালে হয়েছে মাত্র সাত ধরনের পণ্য।
২০২১ সালের ৫ কোটি ৮৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই হিসাবে ২০২২ সালে ১০ লাখ মার্কিন ডলার রপ্তানি কম ছিল। ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব পণ্য বিশ্ববাজারে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সূত্র জানায়, বর্তমানে কিছু রপ্তানিকারক বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছেন। অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার থেকেও সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু এবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই সংখ্যাও কম বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট রপ্তানির পরিমাণের তালিকায় শীর্ষে আছে হাসান জুট মিল। তারা রপ্তানি করেছে ১২ লাখ ২৬ হাজার ৭৪৯ মার্কিন ডলারের পাটজাত পণ্য।
২০২৩ সালে মোট রপ্তানির পরিমাণের তালিকায় শীর্ষে ছিল হাসান জুট মিল। তারা ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে। ২০২২ সালেও বগুড়া থেকে এই প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রপ্তানি করেছিল।
কিন্তু এবার এই পরিস্থিতি কেন, জানতে চাইলে হাসান জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক এটিএম শাফিকুল হাসান জুয়েল জানান, আমাদের পণ্য কাঁচাপাট। এই পণ্যের দাম গত বছর বেশি ছিল। পাটজাত পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমে গেছে। এতে দেশের ব্যাপক পরিমাণ কাঁচাপাট রপ্তানি করা হয়।এই কারণে আমাদের পণ্যের কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার আমাদের উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এর সাথে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবতো আছেই। এ জন্য রপ্তানিও কমে গেছে।
চলতি বছরে রপ্তানি তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাইস ব্র্যান ওয়েল। এটি রপ্তানিকারক বগুড়া মাল্টি ওয়েল মিলস। তারা ১০ লাখ ৪২ হাজার ৯৬০ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
২০২৪ সালে কয়েক দফায় রাজনৈতিক সংকটের কারণে কিছু বিদেশি অর্ডার মিস হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন নর্থ বেঙ্গল গোল্ডেল জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ প্রসাদ কানু। তিনি জানান, আমাদের পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হচ্ছে। কিছু বর্তমানে সেই গতিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আশা করছি দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, ২০২১ সালে তামিম এগ্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড বগুড়া থেকে বেশি রপ্তানিকারকের তালিকায় ছিল। এবার তারা তৃতীয় স্থানে থেকে সাত মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। ২০২০ সালে মজুমদার প্রডাক্টস লিমিটেড রাইস ব্র্যান রপ্তানিতে বগুড়ার শীর্ষ রপ্তানিকারক হলেও গত বছর থেকে তালিকাতে তাদের নাম নেই।
এ বিষয়ে মজুমদার প্রডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার জানান, আগে ভারতে রাইস ব্র্যান ব্যাপক আকারে রপ্তানি হচ্ছিল। এখন রপ্তানি কমে গেছে। আমরা তেল এখন টিসিবিকে দিচ্ছি। এই কারণে রপ্তানি করা হচ্ছে না। এখন দেশেই ব্যবসা ভালো।
তিনি আরও বলেন, ভারতে এবার রাইস ব্র্যান তেলের দাম কম গেছে। আগে শ্রীলঙ্কায় বাজার থাকলেও ওই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবার রপ্তানির সাহস হয়নি।
বগুড়া চেম্বারের কয়েকজন পরিচলক জানান, আগে মজুমদারের প্রতিষ্ঠান বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি করত। এখন তাদের প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। এই কারণে তারা সার্টিফিকেট অব অরিজিন ঢাকা থেকে নেয়। হয়তো সেখান থেকেই তারা ঢাকা থেকেই পণ্য রপ্তানি করে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি প্রতি বছর তাদের রপ্তানির তালিকা প্রকাশ করে। সংস্থাটি বলছে, ২০২৩ সালে বগুড়া থেকে সাত ধরনের পণ্য রপ্তানি করা করা হয়। ২০২২ সালে বগুড়া থেকে ১২ রকমের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল। ২০২১ সালে বগুড়া থেকে ১৬ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়।
এগুলোর মধ্যে রাইস ব্র্যান, পাটজাত দ্রব্য, সেচপাম্প, মোটরপার্টস উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এর আগের বছরে বগুড়া থেকে ওয়েল ফিল্টার বা এয়ার ফিল্টার, সবজি, সয়াবিনজাত, সৌদি রাজকীয় পোশাক, গার্মেন্টস পণ্য বা তৈরি পোশাক, জালি টুপি, হস্তশিল্প পণ্য, ডিজিটাল স্কেল, টিউবওয়েল, নকশিকাঁথা, পাবদা ও শিং মাছ রপ্তানি তালিকায় ছিল। কিন্তু ক্রমেই বগুড়া থেকে রপ্তানি পণ্যের তালিকা কমে যাচ্ছে। এবার সেই তালিকায় রয়েছে শুধুমাত্র রাইস ব্র্যান ওয়েল, পাটজাত দ্রব্য ও সেচপাম্প।
আগের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, চীন, যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। গত বছর থেকে শুধুমাত্র ভারতে বগুড়ার পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।
২০২২ সালে বগুড়ায় তৈরি ১১ হাজার ২৫০ মার্কিন ডলালের এয়ার ও ওয়েল ফিল্টার যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এবার বগুড়া চেম্বারের তালিকায় এই পণ্যের নাম নেই।
বগুড়া থেকে রপ্তানি তালিকায় চাহিদাপূর্ণ পণ্য ছিল বগুড়ার তৈরি সেচ পাম্প। বগুড়ার রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০০০ সালের দিকে সেচ পাম্প রপ্তানির মধ্য বিদেশের বাজারে বগুড়ার পণ্যের যাত্রা শুরু হয়। তবে দিন দিন সেই চাহিদা কমেছে।
বগুড়া থেকে ২০২০ সালে ৫ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ২০১৯ সালে বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ মার্কিন ডলার আয় হয়। ২০১৮ সালে বগুড়া থেকে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৪ হাজার ২৬০ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ২০১৭ সালে বিদেশে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ মার্কিন ডলার।