মুরগির বাচ্চার বাজার টালমাটাল!
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন (বগুড়া লাইভ): দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা ও বন্যার প্রভাবে বগুড়ার এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার বাজারে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাজারে দামের অস্বাভাবিক উথানপতনে হিমশিম খেতে হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই।
হ্যাচারি মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোনালী জাতের একটি বাচ্চা উৎপাদন করতে যে ডিমের দরকার হয় তার দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ হয় প্রায় ২০ টাকা। সেই বাচ্চা এখনকার বাজার মূল্যও ২০ টাকা। গত কয়েকদিনে এই বাচ্চা বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ টাকা দরে।
জয়পুরহাটকে সোনালি মুরগির উৎপাদনস্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেলার প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পোল্ট্রি শিল্প তথা সোনালি মুরগির বাচ্চা, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের ওপর জড়িয়ে আছেন। সম্ভাবনাময় এ শিল্পের দ্রুত উত্থানে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নতুন নতুন পোল্ট্রি ফার্ম ও হ্যাচারি গড়ে উঠেছে।
পোল্ট্রি ভিলেজ খ্যাত জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জে ১৯৭৩ সালে প্রায় ১১ একর জমির উপর নির্মিত হয় সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। সেই থেকে শুরু হয় পোল্ট্রি শিল্পের এগিয়ে চলা। সোনালি জাতের এই মুরগির উদ্ভাবন এখানেই।
জেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের তথ্য মতে, এই শিল্পকে কেন্দ্র করেন বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১১ হাজার পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠেছে। আর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ৮০টি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। জেলায় বছরে মুরগীর বাচ্চার চাহিদা ৪.৫০ কোটি। কিন্তু এখানে উৎপাদন ৮.৫০ কোটি। অর্থাৎ জেলায় প্রয়োজনের চেয়ে ৪ কোটি পিস বেশি মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন হয়। এগুলো বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব মুরগীর বাচ্চা নিয়েই এখন বিপদে পড়েছেন হ্যাচারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বন্যা মিলে ব্যবসার পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে জানিয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা তৌফিকুল ইসলাম। বগুড়ায় একদিনের বাচ্চা বিক্রি ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন তিনি।
তৌফিকুল জানান, এখন প্রতিটি ডিমের দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনে খরচ প্রায় ২০ টাকা। অথচ গত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ টাকার দরেও। সেই দাম বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২০ টাকা দর হয়েছে। কিন্তু আগামিকাল এই দাম কমবে কিনা তার ধারনা কারও কাছে নেই।
এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, এভাবে চলতে থাকল খামারি, হ্যাচারি ও উদ্যোক্তা সবাই ক্ষতির মুখে পড়ছেন। হঠাৎ করে অনেক উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ খেলাপীও হয়েছেন। লোকসানের মুখে বগুড়ার অনেক হ্যাচারি মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। মুরগির বাচ্চার দাম স্বাভাবিক থাকলে এখনও যারা আছেন তারা ভালো থাকবে।
জয়পুরহাটের জামালগঞ্জের মুরগির বাচ্চা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বগুড়ার ‘পোল্ট্রি মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত চকসুত্রাপুরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ২১ আগস্ট সোনালী মুরগির বিক্রি হয়েছে ১৬ টাকা পিস হিসেবে। ২২ আগস্টে ১৩ টাকা, ২৪ আগস্টে ১১ টাকা এবং ২৫ আগস্টে বিক্রি হয়েছে ১৩ টাকা করে।
এরপর অবশ্য মুরগির বাচ্চার দর স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু তা সাময়িক। গত সপ্তাহের শেষের দিকে এসে আবার দরপতন শুরু হয়। ৩১ আগস্ট সোনালী মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ১৫ পিস। ১ সেপ্টেম্বর ১৭ টাকা, ২ সেপ্টেম্বর ১৮.৫০ টাকা, ৩ সেপ্টেম্বর ২০ টাকা ও ৪ সেপ্টেম্বর ২১ টাকা দরে বিক্রি হয়। স্বাভাবিক সময়ে সোনালী জাতের প্রতি পিস মুরগী ২৫ টাকার উপরে বিক্রি হয়।
হাইব্রিড সোনালীর স্বাভাবিক বাজার ৩০ টাকার উপরে। কিন্তু এই জাতের বাচ্চার দামেও উল্লেখযোগ্য পতন ঘটে। গত মাসে হাইব্রিড বগুড়ায় বিক্রি হয়েছে ২০ টাকার নিচে। সম্প্রতি এই দাম বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছিল। কিন্তু আজ ৪ সেপ্টেম্বরের বাজার দর অনুযায়ী হাইব্রিডের দাম এক লাফে ৫ টাকা কমে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়।
এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ী ও হাচারি মালিকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সপ্তাহে গড়ে এক লাখ পিসের বেশি সোনালী জাতের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে জয়পুরহাটের এসএসবি পোল্ট্রি কমপ্লেক্স এন্ড হ্যাচারি। এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বাবু বলেন,এখন ১১ থেকে ১২ টাকা করে বাচ্চা বিক্রি করা হচ্ছে। আমাদেরও উপায় নেই। কারণ এসব ডিমও আমাদের উৎপাদিত। লোকসানের মুখে বাচ্চা উৎপাদন বন্ধেরও কোনো সুযোগ নেই, কারণ এখানে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাদেরও জীবন আছে। চলতে হবে। আবার খামারিকেও বাঁচাতে হবে।
এক দিনের মুরগির ব্যবসার সাথে জড়িতরা বলছেন, বাজার এখানে ডাউন হওয়ার কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বগুড়া পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারী প্রতিদিন অন্তত ৭০ হাজার পিস মুরগীর বাচ্চা বিক্রি করেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক শাকিল আহমেদ বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাচ্চার দাম কমে যায়। এ কারণে গত ৫ আগস্টে ৯ লাখ টাকা লোকসানে পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে আবার বন্যা শুরু হয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলে। এতে আমরা আরও ক্ষতির মুখে পড়েছি।
তিনি আরও বলেন, জয়পুরহাটের সোনালী মুরগির বাচ্চার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীক হাব বগুড়ায়। এখানে প্রতিদিন এক থেকে দেড় কোটি টাকার লেনদেন হয়। গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে আমাদের এখানকার বাচ্চা দেশের সব জেলাতেই যায়। আমরাও চাই ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করুক। নইলে অনেক উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।