প্রধান খবরবগুড়া জেলা

মিরাকল হওয়ার আশায় ছিলেন রাতুলের বাবা-মা

নিজস্ব প্রতিবেদক: কিছু একটা মিরাকল হবে- এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন বগুড়ার শিশু জুনাইদ ইসলাম রাতুলের বাবা-মা ও তার আত্মীয়-স্বজন। কারণ মস্তিষ্কসহ পুরো শরীরে প্রায় সাড়ে চারশ গুলির ভার নিয়ে লড়ে গেছে ৪৯ টি দিন। এই দীর্ঘ সময়টায় চিকিৎসার পাশাপাশি তার স্বজনরা দোয়াও করছিলেন প্রতিনিয়ত! কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল ভিন্ন।

আজ সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন।


জুনাইদ ইসলাম রাতুল বগুড়া শহরের হাকির মোড় ঘোনপাড়া এলাকার মনোহারী ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জিয়ার ছেলে। সে উপশহরে অবস্থিত পথ পাবলিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল।


এর আগে গত ৫ আগস্ট (সোমবার) বিকেলে হাসিনা সরকার পতনের পর বগুড়া সদর থানা এলাকায় আনন্দ মিছিলে গিয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে রাতুল আহত হয়। গুলিতে আহত রাতুলকে উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে স্থানীয়রা। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় ঢাকায়।


রাতুলের বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, সে গুলি খাওয়ার পর একটা লোক সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর আমার ছেলের কাছ থেকেই আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে ফোন দিলে আমি হাসপাতালে যাই। রাতুলকে চারতলায় ভর্তি করানো হয়েছিলো। এরপর ডাক্তাররা হাসপাতালেই তার সিটিস্ক্যান করে দেখলো তার মাথার ভেতর গুলি। এরপর তারা রাতুলকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হয় ওই রাতেই।

উদাস চোখে জিয়াউর বলছিলেন, ছেলেটাকে অনেকবার নিষেধ করেছিলাম এরকম সময় বাইরে না যাওয়ার জন্য। ও বার বার বলতো সে আন্দোলনে যাবে। ওই দিনও নিষেধ করেছিলাম বাড়ি থেকে যেন বের না হয়। এরপরেও সে মিছিলে গেল। পুলিশের গুলি খেলো!

তিনি বলেন, হাসপাতালের ডাক্তাররা খুব ভালোভাবে যত্নের সাথে আমার ছেলের চিকিৎসা করেছে। সরকারও চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমার সন্তান আর পৃথিবীর বুকে আর নাই। তাকে আর ফিরে পাচ্ছি না। এটাই আমার বড় দুঃখ!


পরিবারের সদস্যরা জানান, রাতুলকে ঢাকায় নেয়ার পর থেকেই তার মা রোকেয়া বেগম ও বড় বোন জেরিন সঙ্গে ছিল। রাতুল এক মাস দশ দিনের মতো কোমায় ছিলো। গত তিনদিন আগে সে কোমা থেকে বেরিয়ে আসে। কথা বলছিল ইশারায়। গতকাল মুখে খাবার খেয়েছে। এরপর আজ ভোরে মারা যায় রাতুল। ঢাকায় রাতুলের জানাজা হওয়ার কথা। এরপর মা, বোনের সাথেই রাতুলের মরদেহ আসছে বগুড়ায়। বগুড়ায় আসার পর বাড়ির পাশের নামাজগড় গোরস্থানে রাতুলকে দাফন করা হবে।


কথা বলতে বলতে রাতুলের ঘরে যাওয়া হয়। সেখানে এখনও থরেথরে সাজানো আছে তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র। বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড়, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, বইপত্র, খেলার সামগ্রী, জুতা-স্যান্ডেল সবকিছু।
রাতুলের বাবা জানান, ও ফুটবল খেলা, সাইকেল চালানো এবং স্কেটিং করতে খুব পছন্দ করতো। পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিলো রাতুল। বইয়ে একবার কিছু পড়লে আর দ্বিতীয়বার পড়তে হতো না। সেটিই তার মনে থাকতো।


ছেলেকে নিয়ে আর দশটা বাবা-মায়ের মতো স্বপ্ন ছিল বলে জানান জিয়াউর রহমান। বললেন, রাতুলকে নিয়ে স্বপ্ন ছিলো মিজানুর রহমান আজহারীর মতো একজন আলেম বানানোর। সেই লক্ষ্য নিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর রাতুল আর মাদ্রাসায় পড়াশোনা না করায় তাকে পথ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি। যে কারণে ছেলেকে মিজানুর রহমান আজহারীর মতো একজন আলেম বানানোর চিন্তা থেকে সরে এসে তাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।


বিনা চিকিৎসায় যেন কেউ মারা না যান এবং সঠিক চিকিৎসা যেন সকলে পান সে লক্ষ্যেই তিনি এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ছেলে এমন ভাবে চলে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছেন তিনি।


রাতুলের বোনের শ্বশুর আব্দুর রহমান বলেন, রাতুলের ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম ছিলো। হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডাক্তাররা আমাদের এমনটিই জানিয়েছিলেন। তবে সে যদি বেঁচে থাকে তবে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তার চোখের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলতে পারে। আমরা তার আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বাইরের দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, যদিও ডাক্তাররা এমনটি আমাদেরকে কনফার্ম করেননি যে বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালেই রাতুল সুস্থ হয়ে যাবে।


‘তবু একটা মিরাকলের আশায় বুক বেঁধেছিলাম আমরা। পরিবারের সেই ছেলে আজকে মারা গেলো! তবে রাতুলের চিকিৎসার কোন ত্রুটি হয়নি বলে তিনি দাবী করে বলেন, ডাক্তার থেকে শুরু করে ঢাকার সমন্বয়ক এবং সরকার এবং আত্মীয় স্বজন সকলেই রাতুলের চিকিৎসায় সহযোগিতা করেছেন।’


রাতুলদের বাড়িতে তাদের প্রতিবেশি ও জিয়াউরের বন্ধু সামিউল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, শুধু পড়ালেখা ও খেলা নিয়েই ছেলেটার জগত ছিল। ও তো জীবনের কিছুই বুঝতে পারিনি। অথচ কুঁড়ি অবস্থায় ঝরে গেল।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button