অর্থ ও বানিজ্যপ্রধান খবরশাজাহানপুর উপজেলা

সবজি চারা উৎপাদনে বদলে গেছে বগুড়ার শাহনগরের অর্থনীতি


নিজস্ব প্রতিবেদক: বগুড়ার শাজাহানপুরের শাহনগরের তরুণ ফাহিম হোসেন পড়াশোনা পাশাপাশি চারা উৎপাদন ব্যবসায় জড়িত। তাদের পরিবারের মাত্র ৮ শতক জমিতে সবজি চারা উৎপাদন করে বছরে আয় করেন ৩ থেকে চার লাখ টাকা। তার ভাষ্য একই পরিমাণ জমিতে ধান করে এই আয় কখনও সম্ভব না। একই কারণে তার এলাকার অধিকাংশ কৃষক চারা উৎপাদনের সাথে জড়িত।


সরকারি আজিজুল হক কলেজে গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম জানান, তার বাবাও সবজির চারা উৎপাদন করতেন। মূলত তার হাত ধরে এই ব্যবসায়ে এসেছেন ফাহিম। প্রায় তিন দশক ধরে এই গ্রামে শীতকালীন সবজির চারা সুখ্যাতি রয়েছে।


এসব কারণে চাকরির পিছনে না ছুটে তিনি নিজেও কৃষি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। গ্রিনহাউস ঘরে মাটির বদলে কোকোপিট (নারকেল ছোবড়া) প্লাস্টিকের ট্রেতে বসিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে চারা তৈরি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফাহিম হোসেন নয়, শাহনগরের প্রায় সব কৃষক চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে শাহনগর, বড়পাথার, চুপিনগর, দুরুলিয়া, বৃ-কুষ্টিয়া, খোট্রাপাড়াসহ অন্তত ২০ গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০০ টি ছোট-বড় নার্সারি। এখানে অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ বিঘা জমিতে প্রতি বছর চারা উৎপাদন করা হয়। শাহনগরসহ আশপাশের এলাকায় বছরের পর বছর ধরে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, পেঁপেসহ হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।


শাজাহানপুরের এই সবজির চারা গ্রামের উত্থানের গল্পটাও মজার। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে সামছু পাগলা নামের এক ব্যক্তি এলাকায় বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করতেন। নিজ জমিতে রোপনের পর অবশিষ্ট কিছু চারা বিক্রিও করতেন। কিন্তু ওই সময় কেউ বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করতেন না।


সবজির চারার বাণিজ্যিক ভিত গড়ে ওঠে আমজাদ হোসেন নামে এই গ্রামের এক ব্যক্তির হাতে। ওই সময় অবশ্য তিনি ছিলেন কিশোর বয়সের।


১৯৮৫ সালের কিশোর আমজাদ আধা শতক জমিতে মরিচের বীজ থেকে চারা উৎপাদন দিয়ে শুরু করেন ব্যবসার যাত্রা। এগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। হিসাব করে দেখেন চারা উৎপাদন অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভজনক। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের দিকে এসে আমজাদ ৪ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদনে নেমে পড়েন। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাননি তিনি।


আমজাদের বয়স এখন ৫৩। বদলে গেছে গ্রাম। তিনি শাহনগর নার্সারি মালিক উন্নয়ন সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া আমজাদ এখন নিজেই এগ্রো সীড প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়েও ৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কৃষি-বান্ধব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই অঞ্চলে আগামীতে আরও সুখবর দিতে চান তিনি।


আমজাদ হোসেন জানান, চারা উৎপাদন সংক্রান্ত কাজের ফলে এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি ব্যাপক আকারে বদলে গেছে। অনেক বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগে এই অঞ্চলে বেশিরভাগ জমিতে ধান চাষ হতো। এখন সেই জমিতে চারা উৎপাদন করা হয়। ধানের চেয়ে কয়েকগুণ লাভ হয় চারা উৎপাদনে।


গত প্রায় ৪০ বছরে বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার চোপীনগর ইউনিয়নের শাহনগর এখন পরিচিতি পেয়েছে চারার গ্রামে। এখানে অন্তত ৩ শতাধিক নার্সারি গড়ে উঠেছে।


শাহনগরে উৎপাদিত চারা বিক্রির মৌসুম সাধারণত বাংলা মাসের আষাঢ় থেকে শুরু হয়। চলে কার্তিক মাস পর্যন্ত। কৃষি বিভাগ বলছে, বছরগুলোতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আগাম শীতকালীন সবজি চারা নিতে ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখরিত থাকে শাহনগর। রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় থেকে বরিশাল, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সাভারসহ দেশের অনন্ত ৩০ টি জেলায় বগুড়ার চারা যায়।


নার্সারি মালিকরা বলছেন, বছরে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চারা কিনতে চাষী ও ব্যবসায়ীরা আসেন। এক মৌসুমে অন্তত ৪০ কোটি টাকার চারা কেনা-বেচা হয় শাহনগরে। চলতি বছর প্রতি ১ হাজার চারা বিক্রি হয়েছে ১২০০ থেকে ২ হাজার টাকা দরে। গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর এখানে চারা বিক্রি হয় অন্তত ৪৮ কোটি টাকার। তবে এবার গরমের কারণে চারা উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি আছে বলে জানান তারা। এ ছাড়া গত মাসের শেষের দিকে বৃষ্টিপাত চারা উৎপাদনে সাময়িক ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল।


শাজাহানপুর উপজেলার নার্সারি পল্লীর কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, এখন তাদের ভরা মৌসুম। নার্সারি শ্রমিকেরা সবজি বীজতলায় চারা উৎপাদন, বিক্রি ও পরিচর্যা করছেন।


শাহনগর সাদিক নার্সারির মালিক আরমান হোসেন মিলন এবার দুই বিঘা জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করছেন। ৯ বছর ধরে এ পেশায় থাকা আরমান জানান, প্রতি বিঘায় চারা উৎপাদনে সব মিলে খরচ হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভের পরিমাণ প্রায় একই। অর্থাৎ ২ থেকে ৩ লাখ টাকা।


তিনি বলেন, নার্সারি ব্যবসার আগে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ধান চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। উপজেলার অন্য এলাকার চেয়ে শাহনগড় এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী।


আব্দুর রহিম নামের এক নার্সারি মালিক বলেন, এলাকায় এখন বেশিরভাগই হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা। এর মধ্যে আছে বিজলি, বিজলি প্লাস, গ্রিন সুপার, গ্রিন মাস্টার, লুবা, এন.এস-১৭০১ নানা জাতের চারা। এছাড়া পেঁপে, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোর ক্ষেত্রে হাইব্রিড জাতের চাহিদা বেশি। মোট কথা আমাদের উৎপাদিত চারার গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে এখানকার বাজার ভালো।


সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পাঁচপীর এলাকা থেকে শাহনগরে মরিচের চারা কিনতে এসেছেন চাষী আতিকুর রহমান। ৪৫ শতক জমিতে এবার তিনি মরিচের আবাদ করবেন। আতিকুর বলেন, দেশের অন্য যেকোনা জেলার চেয়ে বগুড়ার সবজির চারার গুণগত মান ভালো। এই কারণে প্রতি বছর এখান থেকে আমরা চারা কিনে নিয়ে যাই। ফলনও ভালো হয়। দামও বেশি পাওয়া যায়।


বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাড়ী চরের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব বলেন, বগুড়া মরিচ উৎপাদনেও বিখ্যাত। আমরা কৃষি অফিস থেকে জেনেছি, ভালো বীজ না হলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না। গত কয়েক বছর ধরে শাহনগর থেকে আমরা মরিচের চারা কিনছি। ফলন দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।


বগুড়ার শাহাজানপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন বলেন, শধুমাত্র এ উপজেলায় প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে নার্সারি রয়েছে। এখানে অন্তত ৩০০ নার্সারি সবজির চারা উৎপাদন করে। এগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। আমরা এই কৃষি উদ্যোগকে আরও বিকশিত করতে, কৃষক সেবা নিশ্চিত করতে নিয়মিত কাজ করেন যাচ্ছি। গ্রিনহাউস চারার গুণগতমান আরও ভালো। আগামীতে এর পরিসব আরও বাড়বে বলে আশাবাদী।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button