দুপচাঁচিয়া উপজেলাপ্রধান খবর

সারাদেশে সরকারি চাল কেনা-বেচা করেন বগুড়ার ফারুক

নিজস্ব প্রতিবেদক: বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন শুধু নিজ এলাকা নয়; দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল ক্রয় করে মজুদ করতেন। এসব সরকারি চাল তিনি বিভিন্ন মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করতেন। দামি ও সরু চালের মধ্যে মেশানোর জন্য ফারুকের চক্রটি সারাদেশে সক্রিয়।

সামাজিক নিরাপত্তাবেস্টনীর ২৭ টন সরকারি চালসহ ফারুক হোসেন গ্রেপ্তারের পর এসব বিষয় উঠে আসে। গত ২৯ অক্টোবর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার তালোড়ায় যৌথ বাহিনীকে সাথে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিভাগ এক অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করে।

ফারুক দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালোড়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁশোপাতা মহল্লার আমিনুর রহমানের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উপজেলায় চালের ব্যবসা করছেন।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তর সূত্র বলছে, দেশব্যাপী সরকারি চাল কালোবাজারির মূল চক্রের একজন ফারুক হোসেন। এই ব্যক্তি শুধু বগুড়া নয়, দেশের সব জেলা থেকেই সরকারি চাল সংগ্রহ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই কালোবাজারি করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। ফারুক চালের বাজারে দেশের বড় কালোবাজারিদের একজন। তার সঙ্গে পাশ্ববর্তী আদমদীঘি উপজেলার আরেক ব্যবসায়ীর যোগাযোগ আছে। মূলত এই দুজন মিলে সরকারি চালের কালোবাজারির চক্র চালান।

মঙ্গলবারেও কালোবাজারি করা সরকারি চাল ফারুকের গুদামে নিয়ে আসার গোপন তথ্য ছিল খাদ্য দপ্তরের কাছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে তালোড়া এলাকার ফারুকের গুদামে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

দপ্তর সূত্র বলছে, মঙ্গলবার সকাল থেকেই ফারুকের গুদাম নজরদারিতে রাখা ছিল। প্রথমে সকালে ট্রাকে করে ১৩ টন চাল প্রবেশ করে ফারুকের গুদামে। দুপুরে দিকে আরও একটি ট্রাকে আরও একটি চালের চালান আসে। এর পরপরই খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অভিযান শুরু করেন।

অভিযান শেষে সেখানে ২৭ টন চালসহ ফারুককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় রাতেই উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক সিহাব উদ্দিন বাদী হয়ে দুপচাঁচিয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

এজাহার সূত্রে জানা যায়, অভিযানকালে তালোড়া-দুর্গাপুর রাস্তার তালোড়ায় একটি ক্বওমী মাদ্রাসার পাশে ফারুকের দুটি গুদাম হতে সুবিধাভোগী বিভিন্ন ভোক্তার কাছে থেকে অবৈধভাবে ক্রয় করা ২৭টন চাল জব্দ করা হয়। এই চালের বাজার মূল্য ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

একই ৫০কেজির ১৫’শ ও ৩০কেজির ১৫’শ সরকারি খালি বস্তা উদ্ধার করে। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাত আরা তিথি ফারুকের দুটি গুদামঘর সিলগালা করে দেয়।

দুপচাঁচিয়া থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম গ্রেপ্তারকৃত ফারুকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গ্রেপ্তারের পর ফারুককে পরের দিন বুধবার আদালতে চালান করা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফারুক হোসেন বেশ কয়েক বছর আগে তালোড়ায় চাতাল ভাড়া নিয়ে ধান-চাল ভাঙ্গানোর ব্যবসা শুরু করেন। তবে এই ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি সরকারি চাল ক্রয় করে বিভিন্ন রাইস মিলে দেয়া শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি ফুলে ফেঁপে ওঠেন। পরবর্তীতে কাহালু উপজেলার ইন্দুখুর গ্রামে তিনি চাতাল দেন। এ চাতাল মূলত সরকারি চাল মজুদ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন ফারুক।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় নেতা- কর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল সুবিধাভোগীদের কাছে ক্রয় করেন। তারা এসব চাল নিয়ে ফারুকের গুদামে সরবরাহ করত। এ ছাড়া ফারুক দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারের রেশনের চাল ক্রয় করে নিয়ে আসতেন।

স্থানীয়রা জানান, সামাজিক নিরাপত্তাবেস্টনী, খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির চাল অনেক মোটা ও গন্ধযুক্ত। এসব কারণে বেশিরভাগ সুবিধাভোগীরা চাল বিক্রি করে দেন। সেই চাল কিনে ফারুক ও চক্রের অন্য কালোবাজারিরা বড় বড় মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করেন।

উপজেলার এক চাতাল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত সরকারের লোকজনের সঙ্গে আঁতাত করে ফারুক শুধু সরকারি চাল কেনা-বেচা ও মজুদ করতেন। সরকারি চালগুলো মূলত অটোরাইস মিলে সরবরাহ করা হয়। অটো মিল ওই চাল নিয়ে সাটার করে। এতে চালগুলো সরু হয়ে যায়। তখন বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সরু ও দামি চালের সাথে মিশিয়ে দেয়। যার কিছু বোঝার উপায় নেই। এভাবে কোটি কোটি টাকার সরকারি চালের অবৈধ ব্যবসা করেছেন তিনি।

পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দা ও তালোড়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মো. হাসেম বলেন, ফারুককে কখনও খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। তবে সে সরকারি চাল ক্রয় করত, এটা এলাকার সবাই জানে। তাকে আমরা নিষেধও করেছি। যেহেতু এটা আইনত নিষিদ্ধ। তাই এই চাল বেচাকেনা না করাই ভালো। মোটা হওয়ার কারণে মানুষরা এই চাল খেতে পারে না। চালগুলো কিনে বড় আকারের রাইসমিল। তারা চালগুলো সরু চালের সাথে মিশিয়ে দেয়।

এ জন্য সরকারকেও বিষয়টি দেখা উচিত বলে মনে করেন মো. হাসেম। তার মতে, যেহেতু চালগুলো মোটা ও গন্ধযুক্ত হওয়ার কারণে মানুষ খায় না। তাই এগুলো দিলে সুবিধাভোগীরা তো বাজারে বিক্রি করবেই।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাল মোটা হতে পারে। কিন্তু এগুলো খুবই পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ। কিন্তু সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে চায় না। গ্রেপ্তার ফারুক সরকারি চালের কালোবাজারির মূল হোতাদের একজন। তাকে দীর্ঘদিন ধরে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছিল। আমরা আশা করছি এই চক্রের সবাই আইনের আওতায় আসবে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button