প্রধান খবরবগুড়া জেলাশিবগঞ্জ উপজেলা

দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন চাষের বিকল্প নেই


আসাফ-উদ-দৌলা নিওন (বগুড়া লাইভ): কৃষি বিভাগের তথ্যমতে দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে দেশে। এ ঘাটতি পূরণে ফি বছর আমদানিতে গুনতে ব্যয় হয় অন্তত হাজার কোটি টাকা। এমন সংকটের সুযোগে বাজারে তৈরি হয় সিন্ডিকেট। ভুক্তভোগী হয় আপামর মানুষ। এমন ক্রান্তিকালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করে দেশের কৃষি গবেষকরা আশার আলো দেখাচ্ছেন।


আলুসহ অন্য অর্থকরী ফসলের কারণে রবি মৌসুমে চাইলেও পেঁয়াজের আবাদ বৃদ্ধি সম্ভব না। সুতরাং পেঁয়াজের চাহিদা পূরণের একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে গ্রীষ্মকালীন জাত। এই জাতের পেঁয়াজ বারোমাসেও করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।


বগুড়ার শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নিয়ে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে। এতে দেশীয় চাহিদা পূরণ হয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সেই লক্ষ্যে প্রান্তিক কৃষকদের উন্নতমানের পেঁয়াজের কন্দ ও চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারা।


শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদার একটি উল্লেখজনক পরিমাণ ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি পূরণে আমাদের নিয়মিত পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আবার পেঁয়াজ পচনশীল পন্য। পরিসংখ্যানে জানা যায় বাছাই, সংরক্ষণ করতে গিয়ে দেশের মোট চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়।


এ ছাড়া আমাদের দেশে রবি অর্থ্যাৎ শীতকালে পেঁয়াজের চাষ হয়। এই মৌসুমে পেঁয়াজের আবাদের জন্য জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতির বিবেচনায় ২০১০-১১ সালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করার উদ্যোগ নেন কৃষি গবেষকরা। এই ধারাবাহিকতায় বারি পেঁয়াজ ২, ৩ ও ৫ নামে তিনটি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন হয়। এর মধ্যে বারি-৫ পেঁয়াজটির ফলন ভালো ও রোগ-বালাই কম । পরবর্তীতে ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে কৃষকদের সাথে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত নিয়ে কাজ শুরু হয়।


পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ২০২০-২১ সালে ২.৫২ লাখ হেক্টর জমিতে গড়ে ৩৩.৬২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। ফলে পেঁয়াজের চাহিদার (৩৬.০০ লাখ টন) তুলনায় উৎপাদন ২.৩৮ লাখ টন কম হওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করে বাড়তি চাহিদা পূরণ করা হয়।


২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাহিদা ছিল ৪০ লাখ টন। আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় মাত্র প্রায় ২৬ লাখ টন। আমদানি করতে হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টন। ঘাটতি থেকে যায় সাড়ে ৬ লাখ টন। মোট সরবরাহকৃত এই পরিমানের মধ্যে উৎপাদন, শুকানো, সংরক্ষণ ও পরিবহণে প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যায়।


ফলে প্রতি বছর গড়ে ৫০০-১০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানী করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই বলে জানান গবেষকরা।
তবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের অভ্যস্ত হতে আরও সময় দরকার। একই সঙ্গে ফসলটি সর্বস্তরের কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত বীজ। এসব কথা জানান বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উর্দ্বতন কর্মকর্তা ড. নুর আলম চৌধুরী। তিনি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আদ্যপান্ত নিয়ে কাজ করছেন।


ড. নুর আলম চৌধুরী বলেন, গবেষণা কেন্দ্র থেকে পেঁয়াজের আবাদ কৃষকের মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় আবাদের পাশাপাশি কৃষকরা বীজ উৎপাদনও করছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসি যৌথভাবে এই কাজে আমাদের সহযোগীতা করছে। আর গবেষণা কেন্দ্র থেকে আমরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষের প্রযুক্তিগত বিষয়টি দেখছি। কৃষকদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।

কৃষকের কথা

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষক কুতুবউদ্দিন প্রায় চার বছর ধরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করে আসছেন। পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করার পাশাপাশি বীজ উৎপাদনও করেন তিনি। কুতুবউদ্দিনের অভিজ্ঞতা বলছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করলে বাজারে চাহিদা পাওয়া যায়। কারণ এখন বাজারে পেঁয়াজের একটু টান থাকে। সবাই মূল মৌসুমের পেঁয়াজের আবাদ শুরু করে। ঠিক এই সময় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বা পেঁয়াজের পাতা ভোক্তার চাহিদা পূরণ করে।
কুতুবউদ্দিন জানান, এই জাতের প্রতিটি পেঁয়াজ ৮০-৮৫ দিনে প্রায় ১০০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায়। তবে পেঁয়াজের লাল রঙ দেখে অনেকে ভারতীয় পেঁয়াজ মনে করে। কিন্তু অফ সিজনের জন্য গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ লাভজনক।

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে আরও গবেষণা

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের ফলন শীতকালীন পেঁয়াজের তুলনায় ২ থেকে আড়াই গুন বেশী। কিন্তু এর সংরক্ষণ ক্ষমতা কম, সর্বোচ্চ আড়াই মাস। আবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে না পারার জন্য বীজ উৎপাদনেও কিছু সমস্যা পোহাতে হয়। এর ফলে এটি কৃষক পর্যায়ে দ্রুত বিস্তারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বছরব্যাপি কন্দ উৎপাদন, সংগ্রহত্তোর ক্ষতি হ্রাস ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে কৃষকদের সেই সংকট দূর করা সহজ হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। এই প্রযুক্তিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ৬ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব।


ড. নুর আলম চৌধুরী জানালেন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের এসব সমস্যা সমাধানে দুটো উপায় বের করেছেন তারা। একটি বাল্বলেট বা পেঁয়াজের ছোট কন্দ। আরেকটি কোকোপিট পদ্ধতি।


কৃষকদের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের কন্দ বা বাল্ব ঘন করে বপন করে দেখছেন গবেষকরা। এতে পেঁয়াজের কন্দ আকারে একটু ছোট হয়। রস কম থাকে, ফলে সংরক্ষণের সময়সীমা বাড়ে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এই পদ্ধতিতে চাষ করছেন কৃষকরা। এ সময়ে যেগুলোর সাইজ বড় হয়, সেগুলো থেকে বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে।


কোকোপিট বা নারকেলের ছোবড়ার গুড়া দিয়ে তৈরি বেডে পেয়াঁজের চাষ বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা প্রথম শুরু করেন। এতে অভাবনীয় ফল তারা পেয়েছেন। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে কোকোপিট পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো বলে দাবি করেন ড. নুর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এ বছর কোকোপিটে বীজ দেয়া হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বারি-৫ বারোমাসি। তাই আমরা দেখছি কোন মাসে সবচেয়ে ভালো ফলাফল আসে।

চাষ বাড়ছে

২৬ টি জেলায় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মাদারীপুর, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অন্যতম। এ ছাড়া বীজের জন্য এসব জেলায় গত বছর ১৫ টি প্রদর্শনী জমি করা হয়েছিল। এ বছর করা হয়েছে ২০টি। প্রতিটি প্লটের জন্য নেয়া হয় ১৫ শতক জমি।


ড. নুর আলম চৌধুরী বলেন, রাজশাহীতে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন জাতের চাষ হচ্ছে। এখন আমরা বীজ উৎপাদন ও কৃষকদের উদ্বুদধ করছি। আমাদের আশা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।


মসলা গবেষণা কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশে আড়াই কোটি বসত বাড়ি আছে। এর মধ্যে এক কোটি বাড়িতে যদি ১ শতক জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করলে ‍উৎপাদন হবে ৩-৪ লাখ টন। এতে আমাদের জাতীয় ঘাটতি অনায়াসে পূরণ করা সম্ভব। আমাদের মূল লক্ষ্য এই উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা কমানো।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button