প্রধান খবরবগুড়া জেলা

বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ছয় দশকেও মুখ দেখেনি ডিজিটাল এক্সরে মেশিনের

হাসপাতালে নানা সংকট


আসাফ-উদ-দৌলা নিওন: ডান হাতের ব্যাথা নিয়ে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এসেছিলেন মোছা. পারুল নামে গৃহবধু। ব্যাথার কারণ জানতে চিকিৎসকের পরামর্শমতে এক্সরে করে সেই কক্ষেই নেগেটিভ ছবিটি হাতে নিয়ে বসেছিলেন তিনি। বসে থাকার কারণ জানতে চাইলে বললেন, এক্সরে পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য বসে আছি। এত দূর আসার কারণ খরচ কমানো। কিন্তু এখানে এসে দেখি এক্সরে হয় এনালগ।

অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে ঐতিহ্যবাহী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আজও রোগীদের এনালগ ব্যবস্থায় এক্সরে সেবা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল ঘুরে এমন আরও বেশ কিছু সংকট-সমস্যার বিষয় উঠে এসেছে। জেলার প্রধান হাসপাতাল হয়েও মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এখনও নানা দিক থেকে অবহেলিত হয়ে আছে।

এসব সংকটের বিষয় মেনে নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সমস্যা সমাধানে নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নওয়াব মোহাম্মদ আলীর উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে শহরের ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঠনঠনিয়া এলাকায় হাসপাতালটি নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে মেডিকেল কলেজের টিচিং হাসপাতাল হিসেবে ২৫০ বেডে উন্নীত করা হয় এ হাসপাতালকে। সে সময় আশেপাশের জেলা থেকেও এই হাসপাতালে সেবা নিতে আসতো রোগীরা।


তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে কখনওই ডিজিটাল এক্সরে মেশিন ছিল না। বর্তমানে এখানে এক্সরে মেশিন আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি ১৯৯২ সালে হাসপাতালে আনা হয়। আরেকটি ২০০৯ সালে। এ দুটিই গত ২০১৯ সাল থেকে নষ্ট। তবে মেরামত করলে চালু করা সম্ভব। মেরামতের বিষয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ একটি পরিদর্শন টিম এসেছিল। কিন্তু ওই উদ্যোগের সেখানেই সমাপ্তি ঘটে।


আর একমাত্র ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি কর্তৃপক্ষ বুঝে পায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিক্যাল কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ আলী হাসপাতালকে এই এক্সরে সরবরাহ করে। কিন্তু সেটি নামেই বুঝে পাওয়া। সিআর নামে একটি যন্ত্রাংশ চালু করতে না পারায় ডিজিটাল হয়েও মেশিনটি দিয়ে ম্যানুয়ালি অর্থ্যাৎ এনালগ ব্যবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে।


হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ঠিকাদারি ওই প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মেশিনটি ইন্সটল না করে দেয়ায় এই ভোগান্তি।
ফলে মেশিনটির ডিজিটাল রিপোর্টের জন্য প্রিন্টারও পড়ে আছে আরেকটি কক্ষে। ডিজিটাল মেশিন ভালো রাখার জন্য এসি দেয়া থাকলেও সেটি ব্যবহার না হচ্ছে না অনেকদিন ধরে। চালু না থাকায় ঘরবন্দি হয়ে নষ্টের পথে রয়েছে প্রিন্টারসহ এসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ।

এক্সরে কক্ষের রেডিওলজিস্ট ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের তিনটি এক্সরে মেশিন। এর মধ্যে একটি চালু আছে। আমাদের এখানে প্রতিদিন অন্তত ৬০ জন রোগী এক্সরে সেবা নিয়ে থাকেন। তবে দুঃখের বিষয় আমাদের ডিজিটাল মেশিনটি চালু করা যায়নি। মেশিন ঠিক রাখার জন্য আমরা ম্যানুয়ালি কাজ করে যাচ্ছি।


হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে তিনটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) আছে। গাইনি, সার্জারি ও ইএনটি। তিনটি ওটি মিলে অজ্ঞান করার যন্ত্র (জিএ মেশিন) আছে একটি। ওটিতে একটি পোর্টেবল এক্স রে মেশিন আছে।

তবে হাসপাতালের আল্ট্রাসোনোগ্রাম মেশিন থেকে ভালো সুবিধা পাচ্ছেন রোগীরা।


হাসপাতালের দো তলায় গিয়ে কথা হয় শহরের জহুরুল নগর এলাকার মুমতাহিনা শারমিনের সঙ্গে। তিনি সম্প্রতি এখানে অপারেশন করেছিলেন। অপারেশন পরবর্তী চেকআপের জন্য এসেছেন চিকিৎসকের কাছে। শারমিন জানালেন, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে সেবা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে এখানকার এক্সরে মেশিনের সেবা ভালো না। আজো এনালগ পদ্ধতিতে এক্সরে হয়। ওটিতেও কিছু সংকট আছে। অনেক সময় ওষুধ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে হাসপাতালের পরিবেশ নিয়ে। ঠিকমতো পরিস্কার করা হয় না। অনেক জায়গায় ময়লা জমে থাকে।


হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, শুধু এসব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশই পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে না। হাসপাতালের মাঝখানে অবস্থিত এক সময়ের শোভাবর্ধনের বাগানটিও হয়েছে ময়লা ও লোহা-লক্করের ভাগাড়। এই বাগানে হাসপাতালের অব্যবহৃত বেড, ট্রলি নিয়ে জড়ো করে রাখা হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় এসব লোহার সরঞ্জাম মরচে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।


রোগীদের অভিযোগ ঝোপঝাড় আর ময়লার কারণে সৃষ্ট মশা-পোকামাকড়ে অতিষ্ঠ থাকতে হয় সবাইকে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা, ভুগতে হচ্ছে রোগীদের।


পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে গেলে বেডে থাকা শহিদুল ইসলাম নামে এক রোগী জানান, চারদিন হলো এখানে ভর্তি হয়েছেন তিনি। রাতে খুব মশার উপদ্রব হয়। এ ছাড়া প্রায় দুর্গন্ধ ছড়ায়।


মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির ৭৫ টিসহ মোট পদ রয়েছে ৪৮৪টি। এর মধ্যে ৪৬টি পদ শূণ্য আছে। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির ৩৩ টি পদ খালি। সিনিয়র কনসালটেন্ট ১১ টি পদের মধ্যে ২ টি শূণ্য। জুনিয়র কনসালটেন্টের ১০ টির মধ্যে শূণ্য ৩টি। ১০ টি নার্সিং সুপারভাইজার পদের বিপরীতে খালি আছে ৪ টি। তবে অন্য নার্সদের পদ পরিপূর্ণ।

মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) রাশেদুল ইসলাম রনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই হাসপাতাল ছিল সবদিক থেকেই অবহেলিত। তবে এখন এসব সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।


হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কাজী মিজানুর রহমান, আমাদের এখানে নার্সদের কোনো সংকট নেই। চিকিৎসকদের সংকট খুব সীমিত। আর ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি আমরা পুরোপুরি চালু করতে পারিনি। এটি নিয়ে আমরা মন্ত্রনালয়ে জানিয়েছি। খুব দ্রুত এর সমাধানের কথা। এটা ছাড়া হাসপাতালের অন্য কোনো যন্ত্রাংশের সংকট নেই। আর বাগানটি নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button