মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম কম, লোকসানে চাষীরা
বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করেছে। তবে দাম কম। উৎপাদন খরচ বেশি। ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পেঁয়াজ চাষীদের। এতে লোকসানে পড়েছেন উত্তরাঞ্চলের তারা।
উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার পেঁয়াজ চাষী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ১ লাখ ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৬০ মণ। অর্থাৎ বিঘায় উৎপাদন হচ্ছে ২৪০০ কেজি। এই হিসাবে প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয় ৫৬ টাকা ২৫ পয়সা।
ব্যবসায়ী ও চাষীরা বলছেন, আজ সকালে চাঁপাইনবাগঞ্জের শিবগঞ্জের এক পাইকারি বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা কেজি দরে। আর রাজশাহীর তাহেরপুর হাটে পাইকারি বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৩ টাকা ৭৫ পয়সা কেজি দরে। পাবনার সুজানগরে গতকাল ৪২ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। আর পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। এই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা।
পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষক মজিবর রহমান এবার আড়াই বিঘা জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের চাষাবাদ করেছেন। তিনি বলেন,এবার মৌসুমের শুরুতে ঘন কুয়াশা ও শীত বেশি থাকার কারণে পেঁয়াজের ফলন কম হয়েছে। গড়ে এবার বিঘায় ৪৫ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর উপর আবার বাজারে দাম কম। বিঘা প্রতি এবার ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।
সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.রাফিউল ইসলাম বলছেন,ভালো দামের আশায় এবার চাষীরা এবার পেঁয়াজের আবাদ বেশি করেছেন। আবার এবার উৎপাদন খরচও কিছুটা বেড়েছে। এ কারণে কিছু চাষী লোকসানে পড়েছেন।
নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার হালতির বিল এলাকার চাষী ও আড়ৎদার রানা আহমেদ বলেন, এবার তিনি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে এখন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। এখন এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বিক্রি এই ৫০ মন পেঁয়াজের দাম হবে ৯০ হাজার টাকা। এখন এই দামে বিক্রি করলে নিশ্চিত লোকসান।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার সতিহাট বাজারের ব্যবসায়ী মোতাহার হোসেন বলেন,এখন পেঁয়াজ কিনে বিক্রি করা খুব কঠিন। অনেক সময় পেঁয়াজ বিক্রি না হলে পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঁচা পেঁয়াজ পাইকারি বাজার থেকে কেনার পর ওজন কমে যায়। সব মিলে অল্প পরিমাণ লাভ থাকে ব্যবসায়ীদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলায় আড়াই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন ওয়ালিদ হাসান। তিনি জানান, এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজের প্রতি মণ বীজ কিনতে হয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায়। এক বিঘা জমিতে অন্তত ৮ মণ বীজ লাগে। সেই সাথে আছে সার,কীটনাশক ও শ্রমিকের খরচ।এবার যদি কেউ বর্গা নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করলে তিনি ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়বেন। এই বাজার পরিস্থতি আসলে স্থিতিশীল থাকা দরকার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মুড়িকাটা পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৩৫ সেক্টর জমিতে।
পেঁয়াজ উৎপাদনের সাথে জড়িত চাষীরা বলছেন,দেশি পেঁয়াজের দাম একটু বাড়লেই হুট করে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।আবার আমদানি চলমানও থাকে।দেশি পেঁয়াজের উৎপাদনের মধ্যে এভাবে আমদানি চলমান থাকলে চাষীরা ক্ষতির মুখে পড়বে।আগ্রহ হারাবে পেঁয়াজ চাষে। তখন দেশে এই মসলা জাতীয় পণ্যের বড় ঘাটতি শুরু হবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে দেশে। এ ঘাটতি পূরণে প্রতি বছর আমদানিতে গুনতে ব্যয় হয় অন্তত হাজার কোটি টাকা। এমন সংকটের সুযোগে বাজারে তৈরি হয় সিন্ডিকেট। এমন পরিস্থিতিতে দেশে নতুন জাতের পেঁয়াজ চাষাবাদ সম্প্রসারণ না গেলে দেশের চাহিদা পুরোপুরি পূরণ হবে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাহিদা ছিল ৪০ লাখ টন। আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় মাত্র প্রায় ২৬ লাখ টন। আমদানি করতে হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টন।
আমদানি নির্ভরতা কমাবে বগুড়ার শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উর্দ্বতন কর্মকর্তা ড. নুর আলম চৌধুরী জানান, দেশে পেঁয়াজের বীজের চাহিদা ১৩শ টন। সেখানে মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ৫ শতাংশ সরবরাহ করতে পারে। বিএডিসি থেকেও একই রকম চাহিদা পূরণ করে। বাকিটা কৃষক ও আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়।কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা গেলে দেশে উৎপাদন বাড়বে। তখন আমদানি নির্ভরতাও কমবে। স্থিতিশীল বাজার হলে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও জয়পুরহাটে এবার ৫৮ হাজার ৩১৩ হেক্টর জমি। এর মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৫৮৬ হেক্টর জমি। দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনা জেলায়।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন,বাজারে সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে কৃষকরা পেঁয়াজ আপাতত সংরক্ষণ করতে পারে। আর মধ্যসত্বভোগীদের মাধ্যম ছাড়া পেঁয়াজ বিক্রি করলে কৃষকরা কম ক্ষতির মুখে পড়বেন।