গাবতলী উপজেলাপ্রধান খবর

বগুড়ার ঐতিহাসিক পোড়াদহ মেলা

জামাইদের আকর্ষণের মাছের জৌলুস কমছে

বছর ঘুরে আবারও বগুড়ার গাবতলীর উপজেলার ইছামতী নদীর পাড়ে জমে উঠেছে পোড়াদহ মেলা। স্থানীয়দের কাছে ‘জামাই মেলা’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক মেলায় একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার মাছ। এ ছাড়া মাছের আদলে তৈরি মিষ্টিও মেলার অন্যতম আকর্ষণ।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আয়োজকেরা বলছেন, মেলায় মাছের জৌলুস প্রতি বছর কমছে। তবে মিষ্টির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রথমে মেলায় মাছের বড় আড়ৎ বসে। তাদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে সারাদিন বিক্রি করেন। এখানে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০টি মাছের স্টল (দোকান) রয়েছে। ভোর থেকে এ মেলায় বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।

ইতিহাস বলছে, প্রায় ৪৫০ বছরের বেশি সময় আগে মেলা সংগঠনের স্থানে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। একদিন সেখানে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়। পরে দলে দলে সন্ন্যাসীরা এসে একটি আশ্রম তৈরি করেন। একপর্যায়ে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে সেটি পুণ্যস্থানে পরিণত হয়।

প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। দিন যত যায়, স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবেই গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার।

স্থানীয়রা জানান, মেলার শুরুটা ছিল কাঠের আসবাবপত্রের বেচাকেনা দিয়ে। কালক্রমে সেই স্থান দখল করেছে মাছ। স্থানীয়রা মেলায় ঈদের উৎসবের মতোই পালন করে থাকেন। মেলার প্রথম দিনে জামাইদের জন্য আয়োজন হয়। পরের দিন থাকে বৌ মেলা। এতে নারীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের পন্য বিক্রি হয়।

মেলায় ব্ল্যাক কার্প, চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল, হাঙড়ি, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড, কালিবাউশ, পাঙ্গাস মাছ যথেষ্ট নজর কেড়েছিল ক্রেতাদের।

স্থানীয় ও মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক মাছচাষী কেবল মেলায় অধিক লাভে বড় মাছ বিক্রয়ের জন্য মাছ বড় করেন। মেলায় বিক্রয়ের জন্য বেশ আগে থেকেই নদী থেকে আইড়, বোয়াল ইত্যাদি মাছ ধরে পুকুরে বা জলাশয়ে বেঁধে রাখা হয়।

মেলার মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকত দুই থেকে আড়াই মণ ওজনের বাগাড় মাছ। কিন্তু বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বাগাড় মাছকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করায় গত তিন বছর ধরে মাছ‌টি মেলায় চোখে পড়েনি।
তবে এবার পাঁচটি দোকানে বাগাড় মাছ নজরে পড়ে।

মেলায় বাগাড় মাছ নিয়ে আসা বিক্রেতা জমির উদ্দিন জানান, মেলায় তিনি প্রতিবছরই মাছ বিক্রি করতে আসেন। এখানে বড় আকারের মাছ বেশি বিক্রি হয়। ক্রেতারা দামাদামি করলেও তারা বড় আকারের মাছ কিনতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই তারা বিভিন্ন জাতের বড় মাছ এ মেলায় উঠিয়েছেন।

তিনি জানান, ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি হিসেবে বাগাড় মাছটির দাম হাঁকিয়েছেন ৬৪ হাজার টাকা। সকাল সকাল ১০ টা পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ক্রেতা মাছটি কিনতে দাম হাঁকিয়েছেন। এরমধ্যে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ৩৩ হাজার টাকা দাম বলেছেন।

মেলায় বাঘাইড় ছাড়াও অনেক মাছ রয়েছে বলে জানান মাছ বিক্রেতা হাবিবুর রহমান, আব্দুল মমিন। তারা জানান, এবারের মেলায় ২ থেকে থেকে শুরু করে ২৫ কেজি ওজনের মাছ নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতি বছর এই সাইজের মাছের চাহিদাই বেশি থাকে বলে জানান তারা।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিকেজি রুই বিক্রি হচ্ছে আকার ভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাতলা ৩৫০ থেকে ৮০০, মৃগেল ২৫০ থেকে ৪০০, গাঙচিল ৩০০, চিতল ৩০০ থেকে ৬০০, বোয়াল ৬০০ থেকে ১২০০, হাঙড়ি ২০০ থেকে ৪০০, গ্রাসকার্প ২৫০ থেকে ৫৫০, সিলভার কার্প ৩০০ থেকে ৫০০, বিগহেড ২৫০ থেকে ৫০০, কালিবাউশ ২৫০ থেকে ৪০০, পাঙ্গাস ২০০ থেকে ৬০০ টাকা।

গাবতলী উপজেলার আনিছুর রহমান জানান, ১১ কেজি ওজনের একটি বিগহেড মাছ কিনেছেন। পরিবার নিয়ে আত্বীয়ের বাড়ি এসছেন তিনি। মেলায় এসে মাছের দরদাম করছেন। কয়েকটা মাছের দোকান ঘুরেই পছন্দমত একটা বিগহেড মাছ কিনেছেন।

মেলায় মাছ কিনতে আসা বগুড়া সদরের বাসিন্দা সায়েম রহমান জানান, প্রতিবছর আমরা এ মেলায় মাছ কিনতে আসি। এবারও এসেছি। মেলায় বিগত বছরে বড় বড় মাছ উঠতো। এবারের মেলায় তুলনায় বড় মাছ উঠেনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের বছরগুলো এই মেলায় অন্তত ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হলেও ২০২০ সাল থেকে তা কমা শুরু হয়েছে।

মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেলা কমিটির সভাপতি আব্দুল মজিদ মন্ডল বলেন, মেলাটি মূলত মাছের। মেলায় প্রায় ৫০০টি মাছের দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলোতে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হবে। মেলার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারীকে অনুরোধ করা হয়েছে।

গাবতলী থানার ওসি আশিক ইকবাল বলেন, মেলাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের একটি টিম কাজ করছে। এছাড়া যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে।

মেলায় জুয়া এবং অশ্লীল নৃত্যের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এরকম অভিযোগ পাওয়ার পর গতকালই আমরা পর আমরা সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছি। মেলায় আবারও এরকম কোন ঘটনার খবর পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবো।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button