প্রধান খবরবগুড়া জেলা

দেড়শ বছরেও কোনো মাস্টারপ্লান নেই বগুড়া পৌরসভায়

ভৌগলিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সব দিক থেকে বগুড়া শহরকে সমৃদ্ধ বলা হয়। আয়তনেও দেশের সর্ববৃহৎ পৌরসভা এটি। কিন্তু প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো হলেও বগুড়া পৌরসভায় আজও কোনো মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্লান) বাস্তবায়ন করা হয়নি।

শহরটি ঘুরে দেখলে এলোমেলোভাবে বিনস্ত্য উঁচু দালান, খানা-খন্দে ভরপুর গলি সদৃশ্য রাস্তা, অপরিকল্পিত নালা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনাই নজরে পড়ে। পৌরবাসীদের আক্ষেপ, টাকা থাকলেই যে যার খেয়াল খুশিমতো দালানকোঠা নির্মাণ করে শহরের বোঝা বাড়াচ্ছে।

বগুড়া পৌরসভার কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন পৌরসভা গঠনের পাঁচ বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর পুরাতনগুলোর ক্ষেত্রে পৌরসভা আইন হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান করতে বলা হয়েছে।

বিগত সময়ে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের ৩২৮টি পৌরসভার মধ্যে ২৫৫টির মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) করে সরকার। এসবের মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে প্রণীত ২৫০টি পৌরসভার মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ গেজেট প্রকাশের আগেই শেষ হয়ে যায়। এসব পরিকল্পনা বিভিন্ন ধাপে ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালে নেয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে বেশ কিছু পৌরসভায় মাস্টারপ্লান নেয়াও হয়েছে। কিন্তু প্রথম সারির পৌরসভা হয়েও প্রাচীন এই শহরটি বঞ্চিত থেকে গেছে।

মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান হলো কোনো অঞ্চল বা শহর সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ কতটুকু জায়গায় বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, মার্কেট, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, সবুজ অঞ্চল, জলাশয় ও শিল্প-কারাখানার হবে তা নির্ধারিত থাকে মাস্টারপ্ল্যানে। ওই নির্দেশনা অনুসরণ করেই জায়গার উন্নয়ন করা হয়।

মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা শহরের ভূমির শ্রেণি, উন্নয়নের ধরন, মানুষের জীবনাচরণ ও চাহিদা বিবেচনা করে ‘নির্দিষ্ট’ সময়ের জন্য মাস্টারপ্ল্যান ডকুমেন্টস তৈরি করা হয়।

বগুড়া পৌরসভার সাম্প্রতিক বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বগুড়া পৌরসভা। কালক্রমে আয়তন বাড়তে বাড়তে এখন ৬৯ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার। ২১ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বগুড়া পৌরসভার জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।

এ পৌরসভায় ১ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার সড়ক এবং ১ হাজার ২১০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। এর মধ্যে ৪৫০ কিলোমিটার পাকা সড়কের বেশির ভাগই ভাঙা। এ ছাড়া কাঁচা সড়ক রয়েছে প্রায় ২৮৬ কিলোমিটার। একইভাবে অধিকাংশ এলাকায় অনেক কাঁচা ড্রেন আছে।

শহরের হালচিত্র নিয়ে ব্যাপক হতাশা ফুটে ওঠে বগুড়া পৌরসভার বাসিন্দাদের মাঝে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানান, শহরের সমস্যাগুলো প্রতিদিনই ভোগায়। রাস্তায় এলোমেলো যানবাহন, যেখানে সেখানে যানযট বাধে। যে যার মতো বাড়িঘর নির্মাণ করে রেখে দিয়েছে। বাড়ি নির্মাণে কেউ প্রয়োজনীয় জায়গা রাখে না। ড্রেনগুলো ছোট, অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত ড্রেনও নেই। প্রতিটি পাড়া, গলিতে ময়লার স্তুপ চোখে পড়ে।

বগুড়ার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শফিক উর রহমান বলছিলেন যে তার বাড়ি থেকে ২০০ মিটার দূরে করতোয়া নদী। এই এলাকার একটি মাস্টার ড্রেন আছে যেটা বাড়ির পিছন দিয়ে নদীতে চলে গেছে। কিন্তু ওই ড্রেনটি তার বাড়ির ড্রেনের চেয়ে উঁচু স্থানে। ফলে বসতবাড়ির বর্জ্য পানি ওই ড্রেন দিয়ে প্রবাহিত হয় না।

পেশায় আইটি উদ্যোক্তা শফিক বলেন, আমার প্রতিবেশীরা ড্রেনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়েনি। ফলশ্রুতিতে একটু বৃষ্টি হলে রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। আর পৌরসভার অপরিকল্পিত ড্রেন ব্যবস্থার জন্যও পানি নিষ্কাশন হয় না। আমরা পৌরসভায় থাকি, সব ধরনের কর দিই। কিন্তু পৌর সুবিধা পরিপূর্ণভাবে পাই না।

শুধু পানি নিষ্কাশনের কথা বললে এমন অবস্থা বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়। এর মধ্যে শহরের কলোনী, খান্দার, সূত্রাপুর এলাকার সমস্যা প্রকট। ড্রেনগুলোর স্বল্প ধারণক্ষমতার কারণেই মানুষকে বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বগুড়ার তরুণ প্রকৌশলী জুনায়েদ মিশারা বলেন, আমাদের দেশে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী স্বল্প জায়গায় বাড়ি নির্মাণ করতে হয়। এ কারণে মানুষের মধ্যে বাড়ির চারিপাশে প্রয়োজনীয় জায়গা ছাড়তে আগ্রহ কম দেখা যায়। তাদের এই প্রবণতার জন্য রাস্তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায় না। সারফেস ওয়াটার নেমে যাওয়ার সুযোগ পায় না।

জুনায়েদ আরও বলেন, মাস্টার প্লান অনুযায়ী উন্নয়ন হলে ওই অঞ্চল বা শহরের সৌন্দর্য বাড়ে এবং এর পরিবেশ ও বাসযোগ্যতা বজায় থাকে। শহরবাসীকে যানজট, জলজট, বায়ুদূষণ প্রভৃতি দুর্যোগ-দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয় না।

বগুড়ার আবাসন ব্যবসায়ী আলী আখতিয়ার তাজু বলেন, এখানে একটা বিশৃঙ্খলা অবস্থা। আপনারা জানেন সম্ভবত বিগত সময়ে বগুড়া পৌরসভায় কোনো বরাদ্দ আসেনি। এ জন্য দেখেন আমাদের পৌরসভায় কোনো ময়লার ভাগাড় নেই। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা। পৌরসভার এই বিশৃঙ্খলা নিরসনে নতুন করে একটা মাস্টার প্লান অবশ্যই দরকার। আমাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে মাস্টার প্লানের বিকল্প নেই।

বগুড়া পৌরসভায় অন্তত ৬৪০০০ হাজার বসতবাড়ি আছে। এর মধ্যে অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ করায় অন্তত ১৪০ টি ভবনকে অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার আইন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরে অন্তত ২৫০ টি অভিযোগ জমা হয় এখানে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাড়ি নির্মাণ, জায়গার সীমানা নিয়ে জটিলতা, মানুষের চলাচলের রাস্তা ও ড্রেনের প্রয়োজনীয় জায়গা না ছাড়াকে কেন্দ্র করেই এসব অভিযোগ হয়ে থাকে। কিছু অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়, কিছু মাসের পর মাস চলতে থাকে।

বগুড়া পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ আল মেহেদী হাসান জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক একটা পৌরসভা গঠনের পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে মাস্টার প্লান গ্রহণ করতে হবে। অথচ বগুড়া পৌরসভার বয়স প্রায় দেড়শ বছর হতে চলেছে, কিন্তু কোনো মাস্টার প্লান নেই।

মাস্টার প্লান না থাকার কারণে পৌরসভায় বিভিন্ন ধরণের ঝামেলা দেখা দিচ্ছে বললেন আল মেহেদী হাসান। জানালেন, এখন যে কেউ যেখানে সেখানে বাড়ি করছেন। রাস্তার জায়গা ছাড়ছেন না। যেখানে পাঁচ তলা ভবন করার অবস্থা রয়েছে, সেখানে নয় তলা দশ তলা ভবন নির্মাণ করছেন। মাস্টার প্লান থাকলে নির্ধারিত নিয়ম অনুসারেই বাড়ি করতে হব

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button