প্রধান খবরবগুড়া জেলা

বগুড়া টাউন ক্লাব, রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে গড়া প্রতিষ্ঠান

বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় টাউন ক্লাব ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত বৃহস্পিতাবার রাতে। বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ক্লাবটি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভেঙে গুড়িয় দিয়েছেন। কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল এই ক্লাব, কেন ভাঙলো বিক্ষুব্ধ জনতা?

টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠার কথা

এই ক্লাবের সাথে জড়িত সাবেক ক্রীড়াবিদ, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও সদস্যরা জানান, বগুড়ার টাউন ক্লাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৮৮৬ সালে। রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে।

বিভিন্ন সময়ের রেজুলেশন, প্রকাশিত বইয়ের বরাত দিয়ে টাউন ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদ শামীম কামাল বলেন, প্রথমে এটি তৈরি করেছিল ইংরেজরা। এর সাথে জড়ি ছিলেন বগুড়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন। তবে প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কিছু ইংরেজ সাহেবরাও ছিলেন। শুরুতে অবশ্য এটি টাউন ক্লাব নামকরণ ছিল না। অন্য নামে ছিল। দুই বছর পরে এটির নামকরণ হলো বগুড়া টাউন ক্লাব।

শুরুর দিকে বগুড়া শহরের জমিদার সাতানী বাড়ি, নওয়াব বাড়ি, ভাণ্ডারি পরিবারের লোকজন ও শেরপুরসহ জেলারকিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন এই ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীও টাউন ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে উল্লেখ করেন টাউন ক্লাবের একাধিক সাবেক খেলোয়াড়।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, শুরুতে টাউন ক্লাব ছিল গণমুখী। গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ছিল, ব্যাপক পরিসরে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। বিশেষ করে বনায়নের দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল। এরপর ক্রীড়ার উন্নয়ন, খেলোয়াড় তৈরি করার উদ্দেশ্য ছিল।

বিভিন্ন পট পরিবর্তনের পর শহরের প্রাণ কেন্দ্র সাতমাথায় পৌনে চার শতক জমির উপর ক্লাব তৈরি করা হয়। এই জমি সরকারি সম্পত্তি। প্রতি বছর ইজারা নেওয়া হয়। দুই শতাধিক সদস্যের এই ক্লাবের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ২১ জন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে বগুড়া টাউন ক্লাবে ১৯৭৭ সালে সদস্য পাওয়া সাবেক ফুটবলার শওকত আলী খান বলেন, এক সময় টাউন ক্লাবের গোড়াপত্তন ঘটে শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে। এরপর এটি স্থানান্তর করা হয় শহরের ঝাউতলা এলাকায়। সময়ের ব্যবধানে মারোয়ারি পট্টি হয়ে বর্তমানের স্থানে ক্লাব প্রতিষ্ঠা পায় বৃটিশ আমলে। ঐতিহ্যের এই ক্লাব আজ ভেঙে খানখান।

কেন ছাত্র-জনতার ক্ষোভের মুখে পড়ল খেলাধুলা নিয়ে থাকা ক্লাব, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই ক্রীড়াবিদ বলেন, ক্লাবটির অবস্থানগত কারণে এটি ঝুঁকির মধ্যে ছিল। টাউন ক্লাবের উত্তরপাশের দেয়াল ঘেঁষে জেলা আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস। দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার ব্যবক্তিগত অফিস। আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে আসা লোকজন টাউন ক্লাবের ওয়াশরুম, পানি থেকে শুরু করে অকে কিছুই ব্যবহার করছিল। এ কারণে অনেকে মনে করে থাকতে পারেন এটি দলের পারপাস সার্ভ করছে। এটি বড় ক্ষোভের কারণ হতে পারে।

সাতমাথায় সার্বক্ষণিক থাকেন (চা বিক্রেতা ও সংবাদকর্মী) এমন ১০ জনের সাথে কথা বলেন জানা গেছে, টাউন ক্লাবে গত ১৫ বছর ধরে শুধু জুয়ার আসর বসানো হতো। এখানে আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা এখান থেকে টাকার ভাগ পেতেন। এই কারণে সাধরণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ হলো এই ভাঙচুর।

বগুড়ার সাবেক একাধিক ক্রীড়া সংগঠক জানান, ক্লাবটি কার্যত অরাজনৈতিক সংগঠন। জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নিবন্ধিত এই ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট ও কাবাডির আলাদা দল আছে। ঐতিহ্য বহনকারী এই ক্লাব ছিল বগুড়ার তথা দেশের, বিদেশের কাছে একটি পরিচিত নাম। গৌরবগাঁথা ক্লাব কেন ভাঙা হল তা জানা নেই তাদের। ক্লাবটির জায়গা যেন বেহাত না হয় এবং নতুন করে যেন নির্মাণ করা হয়- প্রশাসনের কাছে সে দাবি জানান তারা।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম। খেলাধুলা নিয়ে এখনো মাঠের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা সাবেক এই ক্রীড়াবিদ বলেন, “খেলাধুলা নিয়ে বগুড়ায় প্রথম গড়ে ওঠে টাউন ক্লাব। এই ক্লাব অনেকবার কুচবিহারের মহারাজা টুর্নামেন্টে বিজয়ী হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। কলকাতার মাঠ কাঁপানো মাহবুবার রহমানের (বড় কালু) খেলার হাতেখড়ি এই ক্লাব থেকে। পরে তিনি কলকাতার ওরিয়ন ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ খেলেন।”

এছাড়াও প্রথম বিভাগ ক্লাব ও জাতীয় টিমের হয়ে এই ক্লাবের অনেক খেলোয়াড় খেলেছেন। ঢাকার মাঠের আফজাল হোসেন, আজগর হোসেন, অমলেষ সেন, সম্রাট, শিমুল এই ক্লাবেরই সদস্য ছিলেন বলে জানান শহিদুল।

কলকাতা ও বগুড়ার নামকরা সব ফুটবল-খেলোয়াড় টাউন ক্লাবে তৈরি হতো। তারা মোহনবাগান, ইন্টবেঙ্গলে খেলেছেন। সবশেষ ৮০ এর দশকে কয়েকজন মাঠ কাপানো খেলোয়াড় তৈরি হয় এখানে। উত্তরবঙ্গে সবগুলো দলে টাউন ক্লাব অংশগ্রহণ করে বলে জানান সাবেক একাধিক ক্রীড়াবিদ।

ক্লাবের মূলনীতি থেকে সরে যাওয়ার কারণে ভাঙচুর হয়েছেন বলে মনে করেন টাউন ক্লাবের হয়ে ইন্দোপাক ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া খেলোয়াড় আজিজার রহমান। তিনি বলেন, এই ক্লাবটি বগুড়া শুধু নয়, বিশ্বের অনেকের কাছে স্মৃতি বিজরতি। ক্লাবটি প্রকাশ্যে গুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেকের চোখের সামনে। দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সামনে গিয়ে বলার ছিল না। সবাই অসহায় ছিলেন।

বগুড়া শহরের এক সময়ের স্বনামধন্য খেলোয়াড় শাহাজানা আলী বাবু বলেন, ঐতিহাসিক টাউন ক্লাব বগুড়ার মানুষের কাছে অমূল্য সম্পদ। এখানে অনেক খেলোয়াড়ের স্মৃতি রয়েছে। অনেকে দেশের বাহিরে আছেন; তারাও বগুড়ায় এসে একবার টাউন ক্লাব দেখে যান। হঠাৎ বিক্ষুব্ধ জনতা এটা ভেঙে ফেলল।

“এটা যারা ভেঙেছে তারা এর ইতিহাস এতিহ্য সম্পর্কে কিছু জানেন না। জানলে এমন কাজ করতেন না। বগুড়ার নির্মহ ইহিতাসের স্বাক্ষী টাউন ক্লাব ভাঙা ঠিক হয়নি,” যোগ করেন তিনি।

সদস্য কারা, কীভাবে হয়

টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামাল বলেন, তবে চাইলেই এখানে সদস্য হওয়া যায় না। অনেক রকম শর্ত আছে সদস্য হওয়ার জন্য। শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন এর সদস্য হতে পারেন। পুরাতন সদস্যের সুপারিশে নতুন সদস্য নেওয়া হয়।

১৯৯৬ সালে টাউন ক্লাবের সদস্যপদ পান শামীম কামাল। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান ২০০২ সালের পরে। নতুন কার্যকরী কমিটিতেও তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। ক্লাব সচল রূপে ফিরে পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করেন তিনি।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button