জাতীয়প্রধান খবর

ভারতের ঋণ ছাড়ে বিলম্ব, বগুড়াসহ ৩ রেল প্রকল্প থেকে বের হতে চায় সরকার

সরকার ভারতীয় ঋণ-তহবিল থেকে অন্তত তিনটি রেল প্রকল্প প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে, যেগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ বাস্তবায়ন সময়সীমার পরও প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

স্বল্প বিতরণ ও ধীরগতির বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ভারতীয় ঋণের পরিবর্তে বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজছে।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লাগায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি, ভারতীয় ঠিকাদারদের অবহেলার কারণে অগ্রগতি আরও ধীর হয়ে পড়েছে, যার ফলে ব্যয়ও বাড়ছে।

তারা আরও জানান, সরকার অন্যান্য ধীরগতির ভারতীয় ঋণ-তহবিল প্রকল্প থেকেও বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে।

ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য আগামীকাল ঢাকায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলও অংশ নেবে।

ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেবেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্রেডিট লাইনের পরিচালক সুজা কে মেনন, আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকবেন ইআরডির এশিয়া উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বৈঠকে অন্তত তিনটি প্রকল্পকে এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হতে পারে, কারণ বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে এগুলোর জন্য অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজন হচ্ছে। ভারত যদি এ প্রকল্পগুলোর জন্য বাড়তি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি না দেয়, তবে বাংলাদেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার জানান, অনুমোদন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব হচ্ছে। বছরের পর বছর প্রকল্পগুলো চলমান থাকায় ব্যয়ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ঋণ থেকে ৩৭৯.২৯ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলেও বিলম্বের কারণে এখন অতিরিক্ত ৩০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে।

একইভাবে, খুলনা-দর্শনা রেললাইন এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া ডুয়েল গেজ লাইন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নও ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেগুলোর জন্যও অতিরিক্ত তহবিল প্রয়োজন পড়ছে।

বর্তমানে খুলনা-দর্শনা প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ঋণ থেকে ৩১২.৪৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ থাকলেও সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আরও ৩৫০ মিলিয়ন ডলার দরকার। অন্যদিকে, পার্বতীপুর-কাউনিয়া প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ১২০.৪১ মিলিয়ন ডলার, তবে এখন অতিরিক্ত ১২০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এসব হিসাব ২০২৩ সালের ওপর ভিত্তি করে করা হলেও বর্তমান চাহিদা আরও বেশি হতে পারে। গত ছয় বছরে এ তিনটি প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ঋণ বিতরণের হার মাত্র ১ শতাংশ।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থগিত ভারতীয় এলওসি-ভুক্ত প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনা শুরু হয়। যেসব প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইআরডি ও রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং ভারতীয় ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা চূড়ান্ত করার বিষয়ে ভারতকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভারতীয় হাইকমিশনে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া না পেলে বাংলাদেশ প্রকল্পটি বাতিল করবে।

একইভাবে, ২৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা-দর্শনা প্রকল্পের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হয়। তবে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, এখনো ভারত থেকে কোনো উত্তর আসেনি।

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ও খুলনা-দর্শনা রেল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজি জানান, পরামর্শক নিয়োগ করা হলেও এখনো ঠিকাদার চূড়ান্ত করা যায়নি।

তিনি বলেন, ‘এলওসি চুক্তি অনুযায়ী, সব প্রকল্পের নথির জন্য ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন, যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা সম্পন্ন হওয়ার পরও অনুমোদন পেতে অতিরিক্ত সময় লাগছে, যার ফলে প্রকল্পের মূল সময়সীমার একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।’

ফিরোজি জানান, এক্সিম ব্যাংক দেড় বছরেরও বেশি সময় আগে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল প্রকল্পের জন্য ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা পেয়েছিল, কিন্তু এখনো অনুমোদন দেয়নি। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব করে তোলে।’

ভারতীয় ঋণের (এলওসি) মোট পরিমাণ ৭.৩৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প বা প্রকল্পের বিভিন্ন উপাদানে ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়েছে।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

এই বিভাগের অন্য খবর

Back to top button